বাজেট

সাধারণত বাজেট হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার জন্য আয় ও ব্যয়ের প্রাক্বলন। বাজেটের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা,ব্যবস্থাপনা ও ভবিষ্যত অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার ৷
বাজেট বলতে শুধু সরকারি ক্ষেত্রকেই বুঝায় না, এটি ব্যক্তি,পরিবার, ব্যবসায়ী, দেশী বা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান বা যেকোনো সংগঠনের কাজেও হতে পারে।
জাতীয় বাজেট

জাতীয় বাজেট বলতে বাংলাদেশ সরকারের এক বছরের আয় ও ব্যয়ের হিসেবের দলিলকে বুঝায়।সংবিধানের পরিভাষায় বাজেটকে বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি বা ( Annual financial statement) বলা হয়।দেশের বাজেটের এক বছরের জন্য ঘোষণা করা হয় এবং উন্নয়নের জন্য ব্যয় করা হয়ে থাকে। বাজেট হচ্ছে একটি রাজনৈতিক দলিল।
বাজেটের সময়সীমাঃ
প্রতি এক বছরের জন্য বাজেটের ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশে বাজেটের অর্থবছর শুরু হয় জুলাই মাসের এক তারিখ থেকে এবং বাজেটের বছর শেষ হয় পরবর্তী বছরের জুন মাসে। জুলাই থেকে জুন পর্যন্ত বার্ষিক হিসেব নির্ধারণ করা হয়।স্থান, কাল ও দেশ ভেদে বাজেটের অর্থ বছর যেকোনো মাস থেকেই শুরু হতে পারে।
যেমন আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে বাজেট অর্থবছর শুরু হয় এপ্রিল মাস থেকে এবং শেষ হয় মার্চ মাসে।
যেকোনো মাস থেকেই শুরু হতে পারে, ক্যালেন্ডার বা বর্ষপুঞ্জির মাস অনুযায়ী বাজেটের অর্থ বছরের মাস শুরু করতে হবে এরকম কোনো নিয়ম নেই।
বাজেট তৈরির প্রক্রিয়া
চারটি ধাপে বাজেট প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে থাকে। যথাঃ
১. খসড়া দলিল
অর্থ মন্ত্রনালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সমন্বয়ে খসড়া দলিল প্রস্তুত করা হয়।সারা বছর ধরে এ খসড়া দলিল প্রস্তুত করা হয়। এতে আগামী বছরের সম্ভাব্য আয়, কিভাবে আয় করা হবে, কত টাকা আয় করা হবেএবং কোন কোন খাতে ব্যয় করা হবে এবং চলতি বছরের আয় ব্যয় সংবলিত বিস্তারিত বিষয়াদি উল্লেখ থাকে।
২. সিদ্ধান্ত গ্রহণ

বাজেটের তৈরি এই প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন প্রধানমন্ত্রী,অর্থমন্ত্রী, মন্ত্রীপরিষদ ও জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ। এরা ছাড়া প্রণয়নের সিদ্ধানে আর অন্য কোনো ব্যক্তি, পরিষদ বা বোর্ড অংশগ্রহণ করতে পারে না।
৩. আলোচনা
বাজেট নিয়ে আলোচনা করার জন্য সকল সংসদ সদস্যরা সুযোগ পেয়ে থাকেন।
তারা বাজেট নিয়ে আলোচনা করতে পারবেন কিন্তু এই আলোচনায় সংসদ সদস্যদের নতুন কোনো প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় না।
বাজেটের অনুমোদনে সংসদ সদস্যরা হ্যা অথবা না বলতে পারবেন।
কিন্তু তিনি বাজেটের অনুমোদনে না বলতে পারবেন না কারণ হচ্ছে তিনি যদি না বলেন তাহলে সংবিধানের ৭০ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তার সংসদ সদস্যপদ বাতিল হয়ে যাবে।
৪. চূড়ান্ত অনুমোদন
তিনটি ধাপ শেষ হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি বাজেটের চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়ে থাকেন। একমাত্র চুড়ান্ত অনুমোদন দেয়ার ক্ষমতা রাখেন রাষ্ট্রপতি।
বাজেটের ধাপসমূহ
বাজেটের ধাপ হচ্ছে তিনটি
১. প্রস্তাবিত বা খসড়া বাজেট
সার বছর ধরে প্রস্তুত হওয়া বাজেটের যে খসড়া দলিল অর্থমন্ত্রী সংসদে পেশ করেন সেটিই হচ্ছে খসড়া বাজেট। জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে অর্থমন্ত্রী খসড়া বাজেট পেশ করে থাকেন। সংবিধানের ৮৭ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অর্থমন্ত্রী সংসদে বাজেট উপস্থাপন করে থাকেন।
২. সম্পূরক বাজেট
বাজেটে প্রতিটি মন্ত্রনালয়ের জন্য আলাদা বরাদ্দ দেয়া থাকে কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় মন্ত্রণালয়গুলো বরাদ্দকৃত বাজেটের থেকে বেশি খরচ করে ফেলে,
সেক্ষেত্রে অতিরিক্ত খরচ মেটানোর জন্য মন্ত্রণালয়কে আলাদা বাজেট দেয়া হয়ে থাকে, সেই বাজেটকে সম্পূরক বাজেট বলা হয়।
৩. সংশোধিত বাজেট
খসড়া বাজেট পেশ করার পর দীর্ঘ এক মাস ধরে বাজেট নিয়ে তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা শেষে সংশোধিত বাজেট পেশ করা হয়।
বাজেটের শ্রেণিবিভাগ

বাজেট দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত। সুষম বাজেট ও অষম বাজেট
সুষম বাজেট হচ্ছে যে বাজেটের আয় ও ব্যয় দুটি সমান।
অষম বাজেটের মধ্যে আরো বেশ কয়েকটি ধাপ দেখা যায় তা হল
১. বর্ধনীয় বা (incremental) বাজেট।
২. পারফরমেন্স(Performance) বাজেট।
৩. সামগ্রিক বা (Comprehensive) বাজেট।
এছাড়াও আরো একটি উল্লেখযোগ্য বাজেট হচ্ছে ppbs বা planning programming budget system. আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জনসন ১৯৬৫ সালে এই বাজেটের প্রত্যাবর্তন করেন।
বাজেটের অর্থ কিভাবে আসে?
প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে বাজেটের অর্থ আদায় করা হয়। প্রত্যক্ষভাবে যেমন আয়কর,কর্পোরেট কর,সম্পত্তিক উপর আরোপিত কর নেওয়ার মাধ্যমে অর্থ আদায় করা হয়।
পরোক্ষভাবে মূল্য সংযোজন কর বা (vat) ও বিক্রয় করের মাধ্যমে।
তাছাড়া কর বহির্ভূত রাজস্ব যেমন প্রশাসনিক কর (ফি,জরিমানা,বাজেয়াপ্ত) ও বাণিজ্যিক কর যেমন গ্যাস, রেল, ডাক ও বিদ্যুতের রাজস্ব থেকে অর্থ এসে থাকে।
এছাড়াও ইউনিয়ন পরিষদের খাজনা আদায় করার মাধ্যমেও আদায়কৃত অর্থের মাধ্যমে।
বাজেটের অর্থ কোথায় ব্যয় করা হয়?
বাজেটের অর্থ রাজস্ব ব্যয় ও উন্নয়ন ব্যয় এর জন্য খরচ করা হয়।
রাসস্ব ব্যয়ের মধ্যে শিক্ষক,পুলিশ,সামরিক বাহিনী,সরকারী কর্মকর্তার বেতন, বিচারপতির সম্মানী, সরকারী দপ্তর,মেরামত খরচ,দেশি বিদেশি সংস্থার ঋণের বিপরীতে সুদ পরিশোধ করার কাজে ব্যয় করা হয়।
আর উন্নয়ন ব্যয়ের মধ্যে ১৭ টি বিষয়ভিত্তিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, অবকাঠামো নির্মাণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যয় করা হয়।
ঘাটতি ও উদ্ধৃত বাজেটঃ যে বাজেটে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি তাকে ঘাটতি বাজেট বলে।
আর যে বাজেটে আয়ের চেয়ে ব্যয় কম তাকে উদ্ধৃত বাজেট বলে।
বাংলাদেশের বাজেটের সামগ্রিক আলোচনাঃ
বাংলাদেশের বাজেটটি হচ্ছে বর্ধনীয় বা (incremental budget) ব্যবস্থা।
প্রতিবছরের বাজেটেরপর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে বাংলাদেশের বাজেটের পরিমাণ প্রতি বছরই বৃদ্ধি পায় তাই এটি বর্ধনীয় বাজেট। বাংলাদেশের প্রতি ১০০ জনে ১ জন কর প্রদান করেন।
আয়কর ও সম্পদের কর থেকে ৩৫% এবং কর্পোরেট কর থেকে ৬৫% রাজস্ব আদায় করা হয়।
বাংলাদেশে একজন কর দাতাকে ৩৩ ধরনের কর দিতে হয়।
বর্তমান সমীক্ষা অনুযায়ী Tax সার্টিফিকেট পেতে বাংলাদেশে সময় লাগে ৪৩৫ ঘণ্টা। বর্তমানে সরকারের আয় ব্যপক বৃদ্ধি পেয়েছে।
নিয়মিত চিরচরিত খাত সমূহে ৬৯%, উন্নয়নে ৩৯% এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে ১% খরচ করা হয়।
বাজেট হচ্ছে স্বচ্ছতা,জবাবদিহিতা,ব্যবস্থাপনা ও ভবিষ্যত অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।
বাজেটের পেশ করা হয় জুনের প্রথম সপ্তাহে, পাশ হয় শেষ সপ্তাহে এবং কার্যকর হয় জুলাইয়ের ১ তারিখ থেকে।
সরকারি কর্মকর্তা ও প্রভাবশালী মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীরা বাজেট তৈরি করেন।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় বিভিন্ন মন্ত্রনালয় থেকে পরের বছরের খরচের অর্থের তালিকা যোগাড় করেন।
দুর্বলতাঃ বাজেট যেহুতু প্রভাবশালী মন্ত্রী ও সরকারী কর্মকরতাদের মাধ্যমে তৈরি করা হয় এবং এতে সংসদ সদস্যদের কোনো প্রস্তাব নতুন করে গ্রহণ করা হয় না এবং তারা না প্রস্তাব করতে পারেন না।
যেহুতু না প্রস্তাব করলে সংবিধান অনুযায়ী তার সংসদ সদস্য পদ বাতিল হয়ে যাবে এবং সরকারের নীতি নির্ধারকে থেকে যারা বাজেট তৈরি করেন তারা যেহুতু স্থানীয় সরকারের বিষয়গুলি
,তাদের সমস্যা ও তাদের কিরূপ পরিমাণ বরাদ্দ দরকার সে সম্পর্কে অবগত থাকেন না তাই এটি ফলপ্রসু হয় না।
তাছাড়া বাজেটের ফলে নিম্নবিত্ত মানুষের উপর অতিরিক্ত করের বোঝার কারণে তাদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়।
যেহুতু স্থানীয় সরকারের সম্পদ ও আয় সীমিত তাই স্থানীয় পর্যায়ে বাজেটের বরাদ্দের পরিমাণ কম হলে স্থানীয় উন্নয়ন হ্রাস পায়।
পরিশেষে
বাজেটের মুল উদ্দেশ্যই যেহুতু জনকল্যাণ, সেবা ও উন্নয়ন সাধন করা।
তাই সুষ্ঠু বাজেট ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হলে বিকেন্দ্রীকরণ করার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক বাজেট ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে এবং সকলের অংশগ্রহণের ফলে একটি আকাঙ্ক্ষিত বাজেট কার্যকর করা সম্ভব হবে।
এটি কার্যকর করা গেলে এই বাজেটের ফলে স্থানীয় সরকারের গতিশীল উন্নয়নের পাশাপাশি প্রতিটি ব্যক্তি এই বাজেটের মাধ্যমে উপকৃত হবে।
মোঃ ইব্রাহীম চৌধুরী মুন্না
লোকপ্রশাসন বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

অনলাইনে লিখতে ভাললাগা থেকেই এই ব্লগে নিয়মিত লিখে যাচ্ছি। এভাবে নিয়মিত কন্ট্রিবিউট করে যেতে চাই।