পদার্থ বিজ্ঞান: সূচনা, ত্রমবিকাশ, পরিসর, আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান, উদ্দেশ্য।

পদার্থ ও তার গতির সম্পর্কিত বিজ্ঞানকে পদার্থ বিজ্ঞান বলা হয় । পদার্থবিজ্ঞান “পদার্থ” ও “বিজ্ঞান” দুটি সংস্কৃত শব্দ নিয়ে এটি গঠিত। এর ইংরেজি পরিভাষা Physics শব্দটি “প্রকৃতি সম্পর্কিত জ্ঞান” থেকে এসেছে। পদার্থবিজ্ঞান হল বিজ্ঞানের সেই শাখা যার লক্ষ্য আমাদের চারপাশের বিশ্বকে বোঝার চেষ্টা করা।
পাশ্চাত্যের ভাষাগুলিতে পদার্থবিজ্ঞানকে “ফিজিক্স” শব্দটি প্রাচীন গ্রিক “প্রকৃতি”থেকে এসেছে যার অর্থ “প্রকৃতির জ্ঞান”। যেখানে পদার্থ,পদার্থের গতি এবং স্থান ও সময় মাধ্যমে তার আচরণ এবং শক্তি এবং বল সংক্রান্ত রাশি নিয়ে বিষদ আলোচনা করা হয়। পদার্থবিজ্ঞান বিজ্ঞানের সবচেয়ে মৌলিক শাখাগুলোর মধ্যে একটি। পদার্থবিজ্ঞানের মূল লক্ষ্য হলো মহাবিশ্বের আচরণ সম্পর্কে অনুধাবন করা।

পদার্থবিজ্ঞান প্রাচীনতম বিজ্ঞান বিষয়ের মধ্যে অন্যতম কিন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে প্রাচীনতম। শেষ দুই শতকে পদার্থ বিজ্ঞান এর পাশাপাশি রসায়ন, জীববিজ্ঞান এবং গণিতের কিছু শাখা প্রাকৃতিক দর্শনের অংশ ছিল, কিন্তু 17 শতকের বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের সময় প্রাকৃতিক বিজ্ঞান তাদের নিজস্ব অধিকার হিসাবে অনন্য গবেষণা কর্মসূচিতে পরিণত হয়। পদার্থবিজ্ঞান গবেষণায় অনেক আন্তঃসম্পর্কিত এলাকা, যেমন জৈববিজ্ঞান এবং কোয়ান্টাম রসায়ন হিসাবে ছেদ করে, এবং এই কারণে পদার্থবিজ্ঞানের সীমারেখা কঠোরভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয় না। পদার্থ বিজ্ঞানের সকল নতুন ধারণাগুলি প্রায়ই অন্যান্য বিজ্ঞানগুলির মৌলিক পদ্ধতি ব্যাখ্যা করে যখন গণিত এবং দর্শনের ক্ষেত্রে গবেষণার নতুন নতুন উপায়গুলি খোলার সময়।

পদার্থ বিজ্ঞান তাত্ত্বিক সাফল্য থেকে শুরু করে উদ্ভূত নতুন প্রযুক্তির অগ্রগতির মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। উদাহরণস্বরূপ, যদি আমরা তড়িচ্চুম্বকত্ব বা পারমাণবিক পদার্থ বিজ্ঞানের বিকাশের অগ্রগতিগুলি সরাসরি নতুন পণ্যগুলির উন্নয়নের মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছে যা নাটকীয়ভাবে একটি আধুনিক সমাজ নির্মাণে ভূমিকা রাখছে যেমন টেলিভিশন, কম্পিউটার, গার্হস্থ্য যন্ত্রপাতি এবং পারমাণবিক অস্ত্রকে রূপান্তরিত করেছে। এবং তাপবিদ্যায় অগ্রগতি ঘটেছে শিল্পায়ন উন্নয়ন, এবং মেকানিক্স এর অগ্রগতি ক্যালকুলাসের (calculus) উন্নয়ন সাধন করেছেন।

পদার্থবিজ্ঞান এর প্রাচীনতম শাখাগুলির একটি এবং এর সবচেয়ে প্রাচীন উপশাখার আধুনিক নাম জ্যোতির্বিজ্ঞান। প্রকৃতি নিয়ে গবেষণা মানুষের আদিমতম কাজের একটি, কিন্তু পদার্থ বিজ্ঞান বলতে বর্তমানে যে বিজ্ঞান কে বোঝানো হয় তার জন্ম ১৬শ শতাব্দীর বৈজ্ঞানিক বিপ্লব এর সময়ে। যখন এটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণকারী একটি বিজ্ঞানে পরিণত হয় এবং তার আগে প্রকৃতি নিয়ে গবেষণার সাধারণ নাম ছিল প্রাকৃতিক দর্শন, যাকে বিজ্ঞান বলা যায় না।

জড়পদার্থের ধর্ম সম্পর্কে যেসকল বিদ্যা বা শাস্ত্র রয়েছে সেসকল বিদ্যা সম্পর্কে যারা গবেষণা করে অথবা পদার্থবিজ্ঞান গবেষণার সাথে জড়িত ব্যক্তিরা পদার্থ বিজ্ঞানী নামে পরিচিত। পদার্থ বিজ্ঞানীরা আমাদের চারপাশের বস্তুজগৎ সম্পর্কে গবেষণা করে এবং প্রকৃতি কি আচরণ করে আর কেনই বা সেইসব আচরণ করে, তা বোঝার চেষ্টা করেন। তাঁরা এ উদ্দেশ্যে কাজ প্রস্তাব করেন, এবং সেগুলি বাস্তবে পর্যবেক্ষণসম্ভব উপাত্তের সাথে মিলিয়ে দেখেন। এই দিক থেকে পদার্থ বিজ্ঞান রসায়ন ও জীববিজ্ঞানের সাথে সম্পর্কিত। আবার শাস্ত্রটি দর্শন ও গণিতের সাথেও সম্পর্কিত। উল্লিখিত সমস্ত শাস্ত্রগুলির পারস্পরিক সম্পর্ক ও নির্ভরশীলতা সঠিক ভাবে সংজ্ঞায়িত নয়, বরং জটিল। প্রকৃতিকে ভালভাবে বিশ্লেষণ করার জন্য এ সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান এই তিনটি প্রধান বিজ্ঞানে ভাগ করে নেয়া হয়েছে। রসায়নে মৌলিক ও যৌগিক পদার্থ আলোচিত হয়, জীববিজ্ঞানে জীবন ও জীবিত বস্তুসমূহ নিয়ে আলোচনা করা হয়, আর বাকী সব কিছু আলোচনা করা হয় পদার্থবিজ্ঞানে। দর্শন ও গণিতের সাথে পদার্থবিজ্ঞানের সম্পর্ক আরও জটিল। আধুনিক বিজ্ঞান জন্মেরআগ পর্যন্ত পদার্থবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু দর্শনশাস্ত্রে আলোচিত হত এবং বর্তমান দর্শনের নানা শাখায় অধীত বিষয়সমূহ পদার্থবিজ্ঞানীরা ভবিষ্যতে ব্যাখ্যা করার ইচ্ছা রাখেন যদিও তা সম্ভব না-ও হতে পারে। পদার্থবিজ্ঞানের ধারণা ও তত্ত্বগুলি প্রায় সার্বজনীনভাবে গাণিতিক সমীকরণের সাহায্যে প্রকাশ করা হয়। তাই গণিতকে প্রায়ই পদার্থবিজ্ঞানের ভাষা বলে অভিহিত করা হয়। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে উপরের সবগুলি শাস্ত্রের মধ্যে গণিতের সাথেই পদার্থবিজ্ঞানের সম্পর্ক সবচেয়ে নিবিড়। পদার্থবিজ্ঞান গণিতের কিছু শাখার উন্নয়নে সরাসরি সহায়তা করেছে, যেমন – ভেক্টর বিশ্লেষণ। আবার বিজ্ঞানের ইতিহাসে এরকম অনেক ব্যক্তি আছেন যারা গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান উভয়ক্ষেত্রেই পারদর্শী ছিলেন, যেমন – নিউটন, অয়লার, গাউস, পোয়াঁকারে প্রমুখ। পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতের আন্তঃসম্পর্ক পদার্থবিজ্ঞানকে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান ও পরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞান নামের দুইটি প্রধান শাখায় ভাগ করেছে।

তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান এবং এর সংশ্লিষ্ট শাখা গাণিতিক পদার্থ বিজ্ঞানে সাধারণত প্রস্তাব করা হয়, আর পরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞানে এই অনুকল্পগুলিকে প্রকৃতির সাথে পরীক্ষা করে দেখা হয়। এই দুই শাখা একে-অপরের পরিপূরক: তত্ত্বসমূহ পরীক্ষা করা হয় ও পরীক্ষাশেষে উন্নত তত্ত্ব প্রস্তাব করা হয়, যেগুলো আবার পরীক্ষা করা হয় এবং এভাবেই ক্রমশ চলতে থাকে। পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণা মূলত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিগত পরীক্ষাগারে সম্পন্ন করা হয় এবং আধুনিক যুগে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গবেষণা হয় না বললেই চলে। তাত্ত্বিক কাজকর্ম মূলত ব্যক্তিগত হলেও তা অন্যান্য যে সকল বিজ্ঞানী পদার্থবিজ্ঞানীদের সাথে আলোচনা ও সহযোগিতার ভিত্তিতেই ঘটে। বর্তমান আধুনিক যুগে পদার্থবিজ্ঞানীরা সাধারণত পদার্থবিজ্ঞানের যে-কোন একটি বিশেষ ক্ষেত্রের উপর দক্ষতা অর্জন করেন, যা অতীতের পদার্থবিজ্ঞানীদের কর্মপন্থার বিপরীত। অন্যদিকে নিউটন, অয়লার বা গাউসের মত পদার্থ বিজ্ঞানের বিভিন্ন আলাদা শাখার প্রতিটিতে যথেষ্ট অবদান রেখেছেন, এরকম আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞানী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

প্রযুক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে পদার্থবিজ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞানের একটি অন্যতম শাখা। পদার্থবিজ্ঞানীদের কাজ বিদ্যুৎ, মোটর পরিবহন, চিকিৎসা (বিশেষ করে এক্স-রশ্মির ব্যবহার), ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে মানুষকে সাহায্য করেছে। কিন্তু আমরা যদি দেখি অনেক সময় পদার্থবিজ্ঞানকে অনেকে পারমাণবিক বোমা তৈরির মত অনৈতিক কাজেও ব্যবহার করা হয়েছে।

পদার্থবিজ্ঞানীরা যদিও গত প্রায় ৪০০ বছর যাবত প্রকৃতিকে বোঝার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যদিও প্রকৃতিতে এখনও অনেক হাজার সমস্যা রয়ে গেছে যেগুলোর যথাযথ ব্যাখ্যা আজও খুঁজে পাওয়া যায়নি। ফলে পদার্থবিজ্ঞান এখনও একটি সক্রিয় শাস্ত্র; বিশ্ব জুড়ে হাজার হাজার গবেষক পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায় ব্যস্ত। অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে পদার্থবিজ্ঞানে গবেষণার পরিমাণ ও পরিসর দুই টাই অনেক বেশি। পদার্থ বিজ্ঞানের আধুনিক তত্ত্বগুলি কেবল প্রকৃতির শুধু গভীরতর বর্ণনাই দেয়নি বরং এর অনন্য ও রহস্যময় রূপ আমাদের কাছে আরও পরিষ্কার করে তুলেছে।

পদার্থ বিজ্ঞানের পরিসর

পদার্থ বিজ্ঞান

পদার্থবিজ্ঞান বিজ্ঞানের প্রচীনতম শাখা এবং সবচেয়ে মৌলিক শাখা এবং শুধু তাই নয় বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা কোনো না কোনোভাবে এই শাখাকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই পদার্থবিজ্ঞানের পরিসর অনেক বড়। শুধু তাই নয়, পদার্থবিজ্ঞানের নানা সূত্রকে ব্যবহার করে নানা ধরনের প্রযুক্তি গড়ে উঠেছে, সেগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করি। বর্তমান সভ্যতার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে ইলেকট্রনিকসের এবং এই প্রযুক্তির অগ্রগতির পিছে সবচেয়ে বড় অবদান পদার্থবিজ্ঞানের। দৈনন্দিন জীবন ছাড়াও যুদ্ধের ভয়ংকরলীলা থেকে শুরু করে মহাকাশ অভিযান এবং বিভিন্ন রকম গ্রহে পদার্পণ – এরকম প্রতিটি ক্ষেত্রেই পদার্থবিজ্ঞানের ব্যবহার রয়েছে। শুধু তাই নয়, জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা এবং পদার্থবিজ্ঞানকে একত্র করে নিয়মিতভাবে নতুন নতুন শাখা গড়ে উঠেছে যেমন : Astronomy ও পদার্থবিজ্ঞানকে মিলে Astrophysics তৈরি হয়েছে, জৈব প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করার জন্য জীববিজ্ঞান এবং পদার্থ বিজ্ঞান ব্যবহার করে গড়ে উঠেছে Biophysics, রসায়ন শাখার সাথে পদার্থবিজ্ঞান যুক্ত হয়ে জন্ম নিয়েছে Chemical Physics, ভূ-তত্ত্বে ব্যবহার করার জন্য পদার্থবিজ্ঞান ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে Geophysics এবং চিকিৎসাবিজ্ঞান ব্যবহার করে গড়ে উঠেছে Medical Physics ইত্যাদি। কাজেই পদার্থবিজ্ঞানের পরিসর সুবিশাল এবং অনেক গভীর। পঠন-পাঠনের সুবিধার জন্য আমরা পদার্থবিজ্ঞানকে দুটি মূল অংশে ভাগ করতে পারি।

সেগুলো হলো –

ক্লাসিক্যাল পদার্থবিজ্ঞানঃ ক্লাসিক্যাল পদার্থ বিজ্ঞান এর মাঝে রয়েছে বলবিজ্ঞান, শব্দবিজ্ঞান, তাপ এবং তাপগতি বিজ্ঞান, বিদ্যুৎ ও চৌম্বক বিজ্ঞান এবং আলোকবিজ্ঞান।

আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান

কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান এবং আপেক্ষিক তত্ত্ব ব্যবহার করে যে আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞান গড়ে উঠেছে, সেগুলো আণবিক ও পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞান, নিউক্লিয় পদার্থবিজ্ঞান, কঠিন অবস্থার পদার্থবিজ্ঞান এবং পার্টিকেল ফিজিকস নামে পরিচিত ।
বিজ্ঞানের মূল ভিত্তিই হচ্ছে পদার্থবিজ্ঞান। এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে যা কিছু সংগঠিত হয় তার প্রায় সবই পদার্থবিজ্ঞানের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। পদার্থবিজ্ঞানের সকল নীতি ব্যবহার করে বিজ্ঞানের অন্য সকল শাখাসমূহের ভিত্তি তৈরি করা হয়েছে। এই কারনেই পদার্থবিজ্ঞানকে বিজ্ঞানের মৌলিক শাখা বলা হয়।
চিকিৎসাবিজ্ঞান, জ্যোতিবিজ্ঞান, প্রকৌশলশাস্ত্র, জীববিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান সর্বত্র পদার্থবিজ্ঞানের
বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
বিশদভাবে আলোচনা করার সুবিধার্থে পদার্থ বিজ্ঞানকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা
হয়েছে।
এগুলো হলো –
১। বলবিজ্ঞান
২। তাপবিজ্ঞান ৩। শব্দবিজ্ঞান
৪। আলোকবিজ্ঞান
৫। চুম্বক বিজ্ঞান
৬। তড়িৎ বিজ্ঞান
৭। কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞান
৮। নিউক্লিয় পদার্থবিজ্ঞান ইত্যাদি।

পদার্থবিজ্ঞানের ক্রমবিকাশ

আদিপর্ব (প্রিক, ভারতবর্ষ, চীন এবং মুসলিম সভ্যতার অবদান)
বর্তমানে পদার্থবিজ্ঞান বলতে আমরা যে বিষয়টিকে বোঝাই প্রাচীনকালে সেটি শুরু হয়েছিল জ্যোতির্বিদা, আলোকবিজ্ঞান, গতিবিদ্যা এবং গণিতের গুরুত্বপূর্ণ শাখা জ্যামিতির সমন্বয়ে। গ্রিক বিজ্ঞানী দৌশিসের (BC 586-624) নাম আলাদাভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে, কারণ তিনিই প্রথম কার্যকারণ এবং যুক্তি ছাড়া শুধু ধর্ম, অতীন্দ্রিয় এবং পৌরাণিক কাহিনিভিত্তিক ব্যাখ্যা গ্রহণ করতে অনীকার করেছিলেন। থেলিস সূর্যগ্রহণের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন এবং লোডস্টোনের চৌম্বক ধর্ম সম্পর্কে জানতেন। সেই সময়ের গণিতবিদ ও বিজ্ঞানীদের মাঝে পিথাগোরাস (527 BC) একটি স্মরণীয় নাম। জ্যামিতি ছাড়াও কম্পমান তারের ওপর তার মৌলিক কাজ ছিল। গ্রিক দার্শনিক ডেমোক্রিটাস (460 BC) প্রথম ধারণা দেন যে পদার্থের অবিভাজ্য একক আছে, যার নাম দেওয়া হয়েছিল এটম এই নামটি আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান ব্যবহার করে থাকে। তবে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় তার ধারণাটি প্রমাণের কোনো সুযোগ ছিল না বলে সেটি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। সেই সময়কার সবচেয়ে বড় দার্শনিক এবং বিজ্ঞানী এরিস্টটলের মাটি, পানি, বাতাস ও আগুন দিয়ে সবকিছু তৈরি হওয়ার মতবাদটিই অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য ছিল। 310 BC আরিস্তারাকস প্রথমে সূর্যকেন্দ্রিক সৌরজগতের ধারণা দিয়েছিলেন এবংতার অনুসারী সেলেউকাস যুক্তিতর্ক দিয়ে সেটি প্রমাণ করেছিলেন, যদিও সেই যুক্তিগুলো এখন কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। গ্রিক বিজ্ঞান এবং গণিত তার সর্বোচ্চ শিখরে উঠেছিল সর্বকালের একজন শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আর্কিমিডিসের (287 BC) সময় । তরল পদার্থে ঊর্ধ্বমুখী বলের বিষয়টি এখনে বিজ্ঞান বইয়ের পঠনসূচিতে থাকে। গোলীয় আয়নায় সূর্যরশ্মিকে কেন্দ্রীভূত করে দূর থেকে শ যুদ্ধজাহাজে আগুন ধরিয়ে তিনি যুদ্ধে সহায়তা করেছিলেন। গ্রিক আমলের আরেকজন বিজ্ঞানী ছিলেন ইরাতোস্থিনিস (276 BC), যিনি সেই সময়ে সঠিকভাবে পৃথিবীর ব্যাসার্ধ বের করেছিলেন। এরপর প্রায় দেড় হাজার বছর জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা প্রায় বন্ধ হয়েছিল। শুধু ভারতীয় মুসলিম এবং চীন ধারার সভ্যতা গ্রিক ধারার এই জ্ঞানচর্চাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। ভারতবর্ষে আর্যভট্ট (476), ব্রহ্মগুপ্ত এবং ভাস্কর গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যার অনেক মূল্যবান কাজ করেছেন। শূন্যকে সত্যিকার অর্থে ব্যবহার করার বিষয়টিও ভারতবর্ষে (আর্যভট্ট) করা হয়েছিল। মুসলিম গণিতবিদ এবং বিজ্ঞানীদের ভেতর আগ খোয়ারিজমির (783) নাম আলাদাভাবে উল্লেখ করতে হয় । তার লেখা আল জাবির বই থেকে বর্তমান এলজেবরা নামটি এসেছে। ইবনে আল হাইয়াম (965) কে আলোকবিজ্ঞানের স্থপতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আল মাসুদি (896) প্রকৃতির ইতিহাস নিয়ে 30 খণ্ডে এক এনসাইক্লোপিডিয়া লিখেছিলেন। ওমর খৈয়ামের নাম সবাই কবি হিসেবে জানে, কিন্তু তিনি ছিলে উঁচুমাপের গণিতবিদ, জ্যোতির্বিদ এবং দার্শনিক। চীনা গণিতবিদ ও বিজ্ঞানীরাও পদার্থবিজ্ঞান নি অনেক কাজ করেছেন। তাদের মাঝে শেন কুয়োর নামটি উল্লেখ করা যায় (1031), যিনি চুম্বক নিয়ে কাজ করেছেন এবং ভ্রমণের সময় কম্পাস ব্যবহার করে দিক নির্ধারণ করার বিষয়টি উল্লেখ করেছিলেন।

বিজ্ঞানের উত্থানপর্ব

ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতাব্দীতে ইউরোপে পদার্থবিজ্ঞানের জগতে একটি বিস্ময়কর বিপ্লবের শুরু হয়, সময়টা ছিল ইউরোপীয় রেঁনেসার যুগ। 1543 সালে কোপার্নিকাস তার একটি বইয়ে সূর্যকেন্দ্রিক একটি সৌরজগতের ব্যাখ্যা এমন দেন বইয়ের প্রকাশক ধর্মযাজকদের ভয়ে লিখেছিলেন যে এটি সত্যিকারের ব্যাখ্যা নয়, শুধু একটি গাণিতিক সমাধান মাত্র। কোপার্নিকাসের তত্ত্বটি দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর আড়ালে পড়ে ছিল, গ্যালিলিও (1564-1642) সেটিকে সবার সামনে নিয়ে আসেন। তিনি গাণিতিক সূত্র দেওয়ার পর পরীক্ষা করে সেই সূত্রটি প্রমাণ করার বৈজ্ঞানিক ধারার সূচনা করেন। গ্যালিলিওকে অনেক সময় আধুনিক বিজ্ঞানের জনক বলা হয়। তবে সূর্যকেন্দ্রিক সৌরজগতের প্রবক্তা হওয়ার কারণে তিনি চার্চের কোপানলে পড়েছিলেন এবং শেষ জীবনে তাঁকে গৃহবন্দী হয়ে কাটাতে হয়। 1687 খ্রিষ্টাব্দে বিজ্ঞানী নিউটন বলবিদ্যার তিনটি এবং মহাকর্ষ বলের সূত্র প্রকাশ করেন, যেটি বল এবং গতিবিদ্যার ভিত্তি তৈরি করে দেয়। আলোকবিজ্ঞান এবং অন্য আরো কাজের সাথে সাথে বিজ্ঞানী নিউটন লিবনিজের সাথে গণিতের নতুন একটি শাখা ক্যালকুলাস আবিষ্কার করেছিলেন।
অষ্টাদশ শতাব্দীর আগে তাপকে ভরহীন এক ধরনের তরল হিসেবে বিবেচনা করা হতো। 1798 সালে কাউন্ট রামফোর্ড দেখান, তাপ এক ধরনের শক্তি এবং যান্ত্রিক শক্তিকে তাপশক্তিতে রূপান্তর করা যায়। আরও অনেক বিজ্ঞানীর গবেষণার ওপর ভিত্তি করে লর্ড কেলভিন 1850 সালে তাপ গতিবিজ্ঞানের (থার্মোডিনামিক্সের) দুটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র দিয়েছিলেন। বিদ্যুৎ ও চুম্বকের উপরও এই সময় ব্যাপক গবেষণা শুরু হয়।1778 সালে কুলম্ব বৈদ্যুতিক চার্জের ভেতরকার বলের জন্য সুত্র আবিষ্কার করেন।1800 সালে ভোল্টা বৈদ্যুতিক ব্যাটারী আবিষ্কার করার পর বিদ্যুৎ নিয়ে নানা ধরনের গবেষণা শুরু হয়। 1820 সালে অরস্টেড দেখান বিদ্যুৎ প্রবাহ দিয়ে চুম্বক তৈরী করা যায়।1831 সালে ফ্যারাডে ও হেনরি ঠিক তার বিপরীত প্রক্রিয়াটি আবিষ্কার করেন।তারা দেখান চৌম্বক ক্ষেত্রের পরিবর্তন করে বিদ্যুৎ তৈরি করা যায়। 1864 সালে ম্যাক্সওয়েল তার বিখ্যাত ম্যাক্সওয়েল সমীকরণ দিয়ে পরিবর্তনশীল বিদ্যুৎ ও চৌম্বক ক্ষেত্রকে একই সূত্রের মাঝে নিয়ে এসে দেখান যে আলো আসলে একটি বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ। বিদ্যুৎ ও চুম্বক আলাদা কিছু নয়, আসলে এ দুটি একই শক্তির দুটি ভিন্ন রূপ। এটি সময়োপযোগী একটি আবিষ্কার ছিল, কারণ 1801 সালে ইয়ং পরীক্ষার মাধ্যমে আলোর তরঙ্গ ধর্মের প্রমাণ করে রেখেছিলেন। এভাবেই পদার্থবিজ্ঞানের ক্রমবিকাশ ঘটেছে।

আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের সূচনা

জন ডালটন, থমসন এবং রাদারফোর্ড এর ছবি

ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই বিজ্ঞানীরা দেখতে লাগলেন প্রচলিত পদার্থবিজ্ঞান দিয়ে অনেক কিছু ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। 1803 সালে ডাল্টন পারমাণবিক তত্ত্ব দিয়েছেন, 1897 সালে থমসন সেই পরমাণুর ভেতর ইলেকট্রন আবিষ্কার করেছেন, 1911 সালে রাদারফোর্ড। খুবই ক্ষুদ্র নিউক্লিয়াসে পজিটিভ চার্জগুলো থাকে। কিন্তু দেখা গেল নিউক্লিয়াসকে ঘিরে ঘুর ইলেকট্রনের মডেলটি কোনোভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না, কারণ বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় সূত্র অনুযায়ী এই অবস্থায় ইলেকট্রন তার শক্তি বিকীরণ করে নিউক্লিয়াসের ভেতর পড়ে যাবে কিন্তু বাস্তবে তা কখনো ঘটে না। 1900 সালে ম্যাক্স প্লাঙ্ক কোয়ান্টাম তত্ত্ব আবিষ্কার করেন, এই তত্ত্ব ব্যবহার করে পরবর্তীতে পরমাণুর স্থিতিশীলতা ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়েছিল। বিতিরণ সংক্রান্ত কোয়ান্টাম সংখ্যায়ন তত্ত্বের সঠিক গাণিতিক ব্যাখ্যা দিয়ে প্রফেসর সত্যেন্দ্রনাথ বসু পদার্থবিজ্ঞানের জগতে যে অবদান রেখেছিলেন, তার স্বীকৃতিস্বরূপ একশ্রেণির মৌলিক কণাকে বোেজন নাম দেওয়া হয়। 1900 থেকে 1930 সালের এই সময়টিতে অনেক বড় বড় বিজ্ঞানী মিলে কোয়ান্টাম তত্ত্বটিকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গের বাহক হিসেবে ইথার নামে একটি বিষয় কল্পনা করে নেওয়া হয়েছিল এবং 1887 সালে মাইকেলসন ও মোরলি তার অস্তিত্ব আবিষ্কার করার চেষ্টা করে দেখান যে প্রকৃতপক্ষে ইথার বলে কিছু নেই এবং আলোর বেগ রি কিংবা গতিশীল সব মাধ্যমে সমান। 1905 সালে আইনস্টাইনের থিউরি অব রিলেটিভিটি থেকে এই বিষয়টির ব্যাখ্যা পাওয়া যায় থিওরি অব রিলেটিভিটি তেই সূত্র E=me^2 বের হয়ে আসে, যেখানে দেখানো হয় বস্তুর ভরকে শক্তিতে রুপান্তর করা সম্ভব।
কোয়ান্টাম তত্ত্বের সাথে থিওরি অব রিলেটিভিটি ব্যবহার করে ডিরাক 1931 সালে প্রতি পদার্থের (Anti Particle) অস্তিত্ব ঘোষণা করেন, যেটি পরের বছরেই আবিষ্কৃত হয়ে যায়।
1895 সালে রন্টজেন এক্স-রে অবিষ্কার করেন। 1896 সালে বেকেরেল দেখান যে পরমাণুর কেন্দ্র থেকে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ হচ্ছে। 1899 সালে পিয়ারে ও মেরি কুরি রেডিয়াম আবিষ্কার করেন এবং বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন পরমাণুগুলো আসলে অবিনশ্বর নয়, সেগুলো ভেঙে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ হতে পারে।

সম্প্রতি পদার্থবিজ্ঞান

ইলেকট্রনিক্স এবং আধুনিক প্রযুক্তি আবিষ্কারের শক্তিশালী এক্সেলেরেটর তৈরি করা সম্ভব হয় এবং অনেক বেশি শক্তিতে এক্সেলেরেট করে নতুন নতুন কণা আবিষ্কার হতে থাকে। তাত্ত্বিক ব্যবহার করে কণাগুলোকে চমৎকারভাবে বিন্যস্ত করা সম্ভব হয় আপাতদৃষ্টিতে অসংখ্য নতুন নতুন মনে হলেও অল্প কয়েকটি মৌলিক কণা দিয়ে সকল কণার গঠন ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়।কাত্তিক মডেল ব্যবহার করে কণাগুলোর ভর ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয় বলে ঘরের জন্য হিগস-বোসন নামে একটি নতুন কণার অস্তিত্ব ভবিষ্যদ্বাণী করা হয় 2013 সালে পরীক্ষাগারে হিগজ বোজনকেশনাক্ত করা টি তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের বিরাট সাফল্য হিসেবে ধরা হয়। হাজার 924 সালে হাবল দেখিয়েছিলেন মহাবিশ্বের সবগুলো গ্যালাক্সি একে অন্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছে যেটি প্রদর্শন করে যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ধীরে ধীরে প্রসারিত হচ্ছে যার অর্থ অতীতে এক সময় পুরো প্রচণ্ড বিস্ফোরণে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তৈরি হওয়ার পর দেখা যায় এটি প্রসারিত হতে থাকে এবং সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন এই প্রসারণ কখনো থেমে যাবে না বরং বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবকিছু থেকেই একটি অন্যটি থেকে দূরে সরে যাবে। পদার্থবিজ্ঞানীরা আরো দেখিয়েছেন তারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের গ্রহ নক্ষত্র গ্যালাক্সি মাত্র 4% ব্যাখ্যা করতে পারেন বা কি ব্যাখ্যা করতে হলে রহস্যময় ডার্ক মার্ডার ও ডার্ক এনার্জি ধারণা মেনে নিতে হয় যার গঠন নিয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে যাচ্ছেন কঠিন পদার্থ বিজ্ঞানের নিয়ে গবেষণা অর্ধপরিবাহী পদার্থের জন্ম দেয় যে সেগুলো ব্যবহার করে বর্তমান ইলেকট্রনিক্স গড়ে উঠেছে যেটি বর্তমান সভ্যতায় ভিত্তিমূল।

পদার্থ বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য:

বিজ্ঞানের সবচেয়ে উন্নতর শাখাপদার্থ বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানের এই শাখায় শক্তি এবং বলের সহায়তায় সময়ের সাথে বস্তুর অবস্থান পরিবর্তন এর ব্যাখ্যা করা হয় । পদার্থ বিজ্ঞানের মূল উদ্দেশ্য এবং বিষয়বস্তু হচ্ছে নতুনত্ব এর খোজ এবং জানা,পদার্থ বিজ্ঞানের পরিসর অনেক বড় হওয়ায় এর জানার পরিধি ও সুবিশাল, বিভিন্ন ক্ষুদ্র পরমাণু থেকে বিশাল বিশ্বের রহস্য উদঘাটন এবং সত্যতা প্রমান করাই হচ্ছে পদার্থ বিজ্ঞানের মূল উদ্দেশ্য।

Leave a Comment