থাইরয়েড কি? কেন হয়? লক্ষণ কি? এ থেকে মুক্তির উপায় জানুন

থাইরয়েড

বর্তমান বিশ্বে থাইরয়েড একটি পরিচিত রোগ। আমাদের দেশ সহ সারা বিশ্বে অনেক থাইরয়েড রোগী দেখা যায়। আমাদের অনেকেই এই রোগ সম্পর্কে তেমন জানিনা। নির্দিষ্ট ধারণা থাকার কারণে, প্রাথমিক পর্যায়েই এর চিকিৎসা শুরু করতে পারি না। যার কারণে সামান্য সমস্যা থেকে বৃহৎ আকার ধারণ করে। আসুন আমরা এই সম্পর্কে জেনে নিই।

সূচিপত্র hide

থাইরয়েড কি ?

থাইরয়েড একটি গ্রন্থির নাম, যেটা আমাদের গলার নিচের দিকে থাকে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে থাইরয়েড রোগীর সংখ্যা প্রায় দুই কোটি চল্লিশ লক্ষের মতো। অন্যান্য রোগের চেয়ে এই রোগীর সংখ্যা বেশি।

থাইরয়েড গ্রন্থি
থাইরয়েড গ্রন্থি

মানুষের বৃদ্ধি, বিকাশ, শারীরবৃত্তিক আর বিপাকীয় নানা ক্রিয়া-প্রক্রিয়া সাধন করার জন্য এই গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত থাইরয়েড হরমোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই রোগকে বর্তমানে বিশ্বে অন্যতম হরমোনজনিত সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। হরমোনজনিত রোগের মধ্যে ডায়াবেটিসের পরই থাইরয়েডের অবস্থান। মূলত নারীরাই এই সমস্যায় বেশি ভুগে থাকেন।

থাইরয়েড লক্ষণ কি ?

থাইরয়েডের কারণে শরীরে বিভিন্ন লক্ষণ দেখা যায়। একেক জনের ক্ষেত্রে একেক লক্ষণ দেখা যায়। নিচে লক্ষণ গুলো নিয়ে আলোচনা করা হলো।

১। অতিরিক্ত ওজন বেড়ে যাওয়া

থাইরয়েডের কারণে অতিরিক্ত ওজন বেড়ে যায়। এটি থাইরয়েডের একটি লক্ষণ। শরীরের বিপাকের মাত্রা বেড়ে বা কমে গেলে, শরীরে ফ্যাটের মাত্রা হেরফের হয়। যার কারণে শরীরের ওজন বেড়ে যায়।

২। ক্লান্তি বা অবসাদ বেড়ে যাওয়া

এটি থাইরয়েডের একটি সাধারন লক্ষন। থাইরয়েডের কারণে শরীরে ক্লান্তি বাড়ে। অল্প একটু হাটাহাটি করলে বা পরিশ্রম করলেই শরীর ক্লান্ত হয়ে যায়।
থাইরয়েড হরমোন শরীরে শক্তি জোগায়। এই হরমনের কারণে এমন হয়।

৩। অতিরিক্ত ঠান্ডা অনুভব করা

শীতের মাত্রা বেশি না থাকলেও অনেক সময় অতিরিক্ত ঠাণ্ডা অনুভব হয়। শরীর পর্যাপ্ত পরিমাণ ক্যালরী না ঝড়িয়ে ক্যালরি সঞ্চয় করে রাখলে, এমন হয়। এটি থাইরয়েডের লক্ষণ।

৪। অনিয়মিত ঘুম

নিয়মিত ঘুম হতে হতে হঠাৎ ঘুমের পরিবর্তন থাইরয়েডের একটি লক্ষণ। মায়ো ক্লিনিকের এন্ডোক্রিনোলজিস্ট হোসাইন গারিব জানান, ‘ওভারঅ্যাকটিভ থাইরয়েড কিছু হরমোন (যেমন- ট্রাইআইয়োডোথাইরনাইন যা টি৩ নামে পরিচিত এবং থাইরক্সাইন যা টি৪ নামে পরিচিত) অত্যধিক পরিমাণে নিঃসরণ করে সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম বা কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে অতিরিক্ত উত্তেজিত করে এবং ইনসমনিয়া বা অনিদ্রা রোগের দিকে ধাবিত করে।’

অন্যদিকে, সারারাত ঘুমিয়েও যদি ক্লান্তি অনুভব হয়, বা স্বাভাবিক ঘুমের তুলনায় অধিক ঘুমের প্রয়োজন হয়, তাহলে এটি আন্ডারঅ্যাকটিভ থাইরয়েডের লক্ষণ। এখানে শরীর পর্যাপ্ত পরিমাণে হরমোন উৎপাদন করতে পারে না। অনেক সময় অন্যান্য শারীরিক সমস্যার কারনেও অতিরিক্ত ঘুমের দরকার হয়।

৫। চুল পরে যাওয়া

অতিরিক্ত চুল ঝরে যাওয়া, ভ্রু পাতলা হয়ে যাওয়া, থাইরয়েড সমস্যার লক্ষণ। আন্ডারঅ্যাকটিভ থাইরয়েড বা ওভারঅ্যাকটিভ থাইরয়েড চুলের বিকাশ চক্রে বাধা সৃষ্টি করে।

৬। সময়-অসময়ে শরীর ঘামানো

পরিশ্রম না করেও অত্যধিক ঘামানো, হাইপারঅ্যাকটিভ থাইরয়েডের একটি উপসর্গ।
থাইরয়েড শরীরের শক্তি উৎপাদন নিয়ন্ত্রণের কাজ করে। স্বাভাবিক হরমোন মাত্রার চেয়ে উচ্চ হরমোন মাত্রার মানে, মেটাবলিজম অত্যধিক সক্রিয় হচ্ছে, যে কারণে লোকেরা মাত্রাতিরিক্ত গরম অনুভব করে। এর কারণে অতিরিক্ত শরীর ঘামে।

৭। ব্রেইন ফগ

শরীরে থাইরয়েড সঠিকভাবে কাজ না করলে ব্রেইনও কাজ করে না। আন্ডারঅ্যাকটিভ থাইরয়েড থাকা কিছু লোক বলেন, তারা অনেকেই ব্রেইন ফগ বা কুয়াশাচ্ছন্ন মস্তিষ্ক বা অস্পষ্ট মস্তিষ্ক অনুভব করেন।

অন্যদিকে অনেকেই বলেন, তারা সাবটেল মেমোরি লস বা অল্প স্মৃতিভ্রংশতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, অথবা তারা মানসিক ক্লান্তি অনুভব করছেন। ওভারঅ্যাকটিভ থাইরয়েডের কারণে কোনো কিছুতে মনোনিবেশ করা কঠিন হয়ে পড়ে।

৮। অনিয়মিত ঋতুস্রাব

শরীরের অন্যান্য হরমোনের সঙ্গে থাইরয়েড হরমোনের সম্পর্ক আছে। সেই হরমোনের বেড়ে যাওয়া বা কমে যাওয়ার কারণে অন্যান্য হরমোনের কার্যকারিতা প্রভাবিত হয়। ঋতুস্রাব জড়িত হরমোনের ক্ষেত্রেও এই সমস্যা দেখা দিতে পারে। যার ফলে ঋতুস্রাবের সময় এবং তীব্রতায় সমস্যা হয়। অনিয়মিত ঋতুস্রাব হয়। মাঝেমাঝে বিলম্ব ঘটে।

৯। অবসন্নতা

যারা থাইরয়েডের সমস্যায় ভুগেন, তারা অবসন্নতা অনুভব করেন। প্রায়ই মন মেজাজ খারাপ থাকে। সবকিছুতে বিরক্তি এসে যায়। ভাল জিনিসের প্রতিও অনিহা জাগে। কখনো কখনো মুড সুইং ও হয়।

১০। হঠাৎ উদ্বেগ প্রকাশ

কখনো উদ্বেগের মধ্যে না থাকা কেউ হঠাৎ করে ধারাবাহিকভাবে উদ্বেগ বা অস্থিরতা অনুভব করলে, থাইরয়েড হাইপারঅ্যাকটিভ হতে পারে। অত্যধিক হরমোন প্রায়ক্ষেত্রে রোগীকে নার্ভাস বা স্নায়বিক দুর্বলগ্রস্ত কিংবা উদ্বিগ্ন করে তোলে। সেখানে অত্যধিক ব্রেইন স্টিমিউল্যান্ট বা মস্তিষ্ক উত্তেজক আছে যা কোনো বিষয়ে ভালো অনুভব না করলে তাকে উত্তেজিত করে তোলে।

১১। বিনা শ্রমে হার্ট প্যালপিটেশন

অত্যধিক থাইরয়েড হরমোন শরীরের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে। অনেকে অত্যধিক ক্যাফেইন অনুভব করে অথবা তারা বিশ্রামে থাকলেও হার্ট প্যালপিটেশন বা বুক ধড়ফড় অনুভব করে।

১২। বন্ধ্যাত্ব বা গর্ভপাত হওয়ার সম্ভাবনা

যেসব নারীর বন্ধ্যাত্বের ফ্যামিলি হিস্ট্রি নেই, কিন্তু কনসিভ করতে সমস্যায় পড়ে যান অথবা যাদের প্রেগন্যান্সির প্রাথমিক পর্যায়ে মিসক্যারেজ বা গর্ভপাত হয়ে যায় তাদের থাইরয়েড স্ক্রিনিং করানো উচিত। নিম্ন হরমোন মাত্রা ওডিউলেশন এবং প্রিডিস্পোজকে প্রভাবিত করে বন্ধ্যাত্ব বা অকাল গর্ভপাত ঘটায়। যদি থাইরয়েড রোগ থাকে, তাহলে কনসিভের চেষ্টা এবং প্রেগন্যান্সির সময় হরমোন সাপ্লিমেন্টেশন খুব উপকারে আসতে পারে।

পড়ুন এনজিওগ্রাফি, এনজিওগ্রাম, এনজিওপ্লাস্টি, কি, কেন, কিভাবে করা হয় ?

এক্স রে কিভাবে কাজ করে? এক্স-রে কি কি রোগ নির্নয় করে এর ক্ষতিকর দিক

থাইরয়েড কেন হয়?

থাইরয়েড হওয়ার মূল কারণ আয়োডিনের অভাব। মানুষের শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণ আয়োডিনের অভাব হলে এই রোগটি দেখা দিতে পারে। আমাদের দেশে আয়োডিনের অভাব থাকায়, এই রোগটি বেশি দেখা যায়।

থাইরয়েড
থাইরয়েড

থাইরয়েডের ভেতর গয়টার বড় সমস্যা। গলার নিচের দিকে ফুলে যাওয়াকে গয়টার বলে। আমাদের দেশে, গয়টার একটি বড় সমস্যা। সেই সাথে বাচ্চারা আয়োডিনের অভাবে ত্রুটিপূর্ণভাবে জন্মগ্রহণ করে থাকে। লবণ শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর হলেও এটি থাইরয়েড সমস্যার মোকাবিলা করতে সক্ষম।

জেনেটিক কারণেও এই রোগ হতে পারে। অর্থাৎ যদি মা, বাবা, দাদার অথবা পূর্বপুরুষের কারো থাকে সেই ক্ষেত্রে জেনেটিক ভাবে থাইরয়েডের সমস্যা হতে পারে।

থাইরয়েডের চিকিৎসার জন্য কেউ রেডিও আয়োডিন খেয়ে থাকলেও থাইরয়েডের সমস্যা হতে পারে। গলায় চার্জারী হলেও সে ক্ষেত্রেও থাইরয়েডের সমস্যা দেখা দিতে পারে।

থাইরয়েডের জন্য নিষিদ্ধ খাবার

যে কোন রোগের ক্ষেত্রে খাবারের কিছু নিয়ম কানুন রয়েছে। তাই এই নিয়ম কানুন গুলো মেনে চলা জরুরী। খাবারের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকলে থাইরয়েড থেকে দূরে থাকা যায়। চলুন জেনে নিই থাইরয়েডের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ খাবার গুলো।

  • থাইরয়েডের ক্ষেত্রে সয়াবিন বা সয়াবিন জাত সব ধরনের খাবার পরিহার করা উচিত। বিশেষজ্ঞরা বলেন, সয়াবিন জাতীয় খাবার খেলে থাইরয়েডের ওষুধ ঠিক মতো কাজ না। তাই সয়াবিন, সয়ার দুধ, টফুর মতো খাবারের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা উচিত।
  • থাইরয়েডের সমস্যা হলে, ব্রোকোলি, বাঁধাকপি ও ফুলকপি খাওয়া যাবে না।
    অনেকেই ওজঙ্কমাতে ফুলকপি বা কেল পাতার মতো শাক-সবজি খান। কিন্তু থাইরয়েড সমসা থাকলে এটি পরিহার করতে হবে।
  • থাইরয়েড রোগীদের ক্ষেত্রে চা কফি ক্ষতির কারণ হতে পারে। এতে ক্যাফিন রয়েছে। ওষুধ খাওয়ার পরে ক্যাফিন সেবন করলে রোগ বড়ার সম্ভাবনা থাকে। ক্যাফিন থাইরয়েড গ্রন্থি এবং থাইরয়েডের স্তর উভইয়েরই বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। তাই থাইরয়েডের সমস্যা থাকলে ক্যাফিন আছে এমন খাদ্যের থেকে দূরে থাকা উচিত।
  • আমরা জানি থাইরয়েডের ক্ষেত্রে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরী। কিন্তু মিষ্টিজাতীয় খাবার শরীরে ফ্যাটের মাত্রা বৃদ্ধি করে। এতে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে যায়। তাই মিষ্টিজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।
  • বাজারে থাকা প্যাকেটজাত খাবার পরিহার করতে হবে। কারণ এতে লবন, চিনি, তেলের পরিমাণ বেশি থাকে। যা দ্রুত ওজন বৃদ্ধি করে। তাই বাজারের প্যাকেট জাত পণ্য পরিহার করতে হবে।
  • থাইরয়েডের ক্ষেত্রে দুগ্ধজাত খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। কারণ এসব খাবার শরীরে হরমোনের তারতম্য আরও বাড়িয়ে দেয়। তাই দুধ, মাখন, চিজের মতো খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।
  • রেড মিটে স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং কোলেস্টেরল খুব বেশি থাকে। রেড মিট খেলে চর্বি খুব দ্রুত বাড়ে। তাই থাইরয়েডের ক্ষেত্রে এসব এড়িয়ে চলতে হবে।

থাইরয়েডের জন্য উপকারী খাবার

আপনার খাদ্যাভ্যাস আপনাকে থাইরয়েড থেকে মুক্তি পেতে সহায়তা করে, আপনাকে সুস্থ রাখতে হবে। থাইরয়েড থেকে দূরে থাকতে নিচের খাবারগুলো খাওয়া উচিত।

১, প্রোটিন জাতীয় খাবার ব্লাড সুগারকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। এ ছাড়া বিপাকক্রিয়া উন্নত করে অতিরিক্ত খাওয়ার প্রবণতা থেকে রক্ষা করে, এটি ওজন নিয়ন্ত্রণে বেশ ভূমিকা রাখে। তাই প্রতিদিন দুটি ডিম, দুই টুকরা মাছ বা মাংস, বাদাম, ডাল, ছোলা, শিম প্রভৃতি খাওয়া খাওয়া উচিত। এগুলো থাইরয়েডের জন্য উপকারী।

২, শরীরে হরমোনাল ব্যালান্স, ওজন নিয়ন্ত্রণ ও গর্ভধারণের জন্য স্বাস্থ্যকর চর্বি বেশ উপকারী। নরমাল ফ্যাট শরীরে ক্ষতি করলেও, হেলদি ফ্যাট বেশ ভালো। হেলদি ফ্যাটের উৎস হলো নারকেল তেল, এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল, তিসি, অ্যাভোকাডো ইত্যাদি।

ঘরে বানানো নারকেল তেল দিয়ে রান্না করে খাওয়া গেলে, খুব ভালো। যাদের নারকেল তেল খেয়ে অস্বস্তি লাগে, তারা নারকেল খেতে পারেন। এছাড়া এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েলে রয়েছে মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাট, পলিফেনল ও ফাইট্রোনিউট্রিয়েন্ট। যেসব উপাদান থাইরয়েড উৎপাদনে বেশ সহায়ক।

৩, আমরা জানি আয়োডিনের অভাবে থাইরয়েড সমস্যা হয়। তাই আয়োডিন জাতীয় খাবার খাওয়া জরুরী। আয়োডিন থাইরয়েড হরমোন তৈরি করতে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আয়োডিনের উৎস হিসেবে রান্নায় আয়োডিনযুক্ত লবণ ব্যবহার করতে হবে। তবে আয়োডিনযুক্ত লবণের সঠিক গুণাগুণ পেতে হলে লবণ অতিরিক্ত তাপমাত্রার মধ্যে বা চুলার পাশে রাখা যাবে না। চিজ, পেঁয়াজ, রসুন, ভুট্টা, আনারস, টমেটো, স্ট্রবেরি, সামুদ্রিক মাছ স্যালমন, স্যামন, সারডিন, হেরিং প্রভৃতি আয়োডিনের উৎস।

৪, শরীরে টাইরোসিন কমে গেলে থাইরয়েডের পরিমাণ কমে যায়। এ জন্য লাল মাংস, টার্কি মুরগির বুকের মাংস, স্যালমন মাছ, কলা, মিষ্টি কুমড়ার বিচি ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে। এতে উচ্চ টাইরোসিন থাকে।

৫, জিংক শরীরে থাইরয়েডে হরমোন সংশ্লেষণ করতে কাজ করে। তাই পর্যাপ্ত পরিমাণে জিংক খাবার খেতে হবে। জিংক এর উৎস হিসেবে ডিম, দুধ, পনির, লাল মাংস, তরমুজের বিচি, রসুন, বাদাম, তিল প্রভৃতি খাওয়া যেতে পারে। প্রতি ১০০ গ্রাম তিল থেকে ৮ গ্রাম জিংক পাওয়া যায়।

৬, থাইরয়েড ফাংশনে লিভারের সহায়ক হিসেবে কাজ করে সেলেনিয়াম। এর ভালো উৎস হলো ব্রাজিল নাটস। এ ছাড়া লাল চাল, চিংড়ি, টুনাফিস, সরিষা, ইলিশ মাছ, শসা ইত্যাদি সেলেনিয়ামের ভালো উৎস।

৭, ভিটামিন এ থাইরয়েড হরমোন উৎপাদন ও নিঃসরণে সাহায্য করে পাশাপাশি টি-থ্রিকে টি-ফোরে রূপান্তরে সাহায্য করে। এর উৎস গাজর, মিষ্টি কুমড়া, পাকা পেঁপে, হলুদ ও সবুজ শাক-সবজি।

৮, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ‘ডি’র অভাবে রক্ত শরীর থেকে চামড়ায় যেতে বিঘ্ন ঘটে। ফলে হাত-পায়ে প্রচুর ব্যথা হয়। তাই থাইরয়েড হরমোনে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ‘ডি’-এর ভূমিকা অপরিহার্য। ভিটামিন ‘ডি’ পেতে হলে নিয়মিত সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টার মধ্যে কমপক্ষে আধাঘণ্টা রোদে থাকতে হবে। যাঁদের রোদে যাওয়ার সুযোগ নেই, তাঁরা তৈলাক্ত মাছ, গরুর কলিজা, ডিম, পনির, তিল, সবুজ শাক-সবজি পালংশাক, কমলালেবু থেকে পেতে পারেন।

৯, থাইরয়েডের জন্য আয়োডিনের আরেকটি ভালো উৎস হচ্ছে সামুদ্রিক মাছ। এদের মধ্যে স্যালমন মাছ আপনার থাইরয়েডের জন্য সবচেয়ে বেশি সহায়ক হতে পারে। প্রদাহ থাইরয়েডের ফাংশনে ব্যাঘাত ঘটায়, কিন্তু স্যালমন মাছের ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড প্রদাহ প্রশমিত করে থাইরয়েডের ফাংশন সুষ্ঠু রাখে।

থাইরয়েডের জন্য যেসব সমস্যা হয়

থাইরয়েডের কারণে আমাদের বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে। যারা থাইরয়েড সমস্যায় ভুগছেন, তারা নিয়মিত এই সমস্যাগুলোর সম্মুখীন হন। চলুন জেনে নিই সমস্যাগুলো।

১, যেহেতু থাইরয়েড গলায় সমস্যা তৈরী করে। তাই থাইরয়েড সমস্যার জন্য খাবার গিলতে অসুবিধা হয়। গলা ব্যাথার কারণে এই সমস্যা হয়।

২, থাইরয়েডের কারণে ঘাড়ে যন্ত্রণা হয়। এই যন্ত্রণার কারনে ঘুমানো সহ বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।

৩, থাইরয়েডের কারণে শিশুদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং বয়ঃসন্ধি কাল বিলম্বিত হয়।

৪, থাইরয়েড সমস্যার জন্য সামান্য একটু হাটাহাটি করেলেও শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। অল্পতেই শরীর ক্লান্ত হয়ে যায়।

৫, থাইরয়েড গ্রন্থি বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে গয়টার হয়। গলা ফুলে যায়।

৬, থাইরয়েড গ্রন্থি ঠিকঠাক কাজ না করলে তার প্রভাব মেয়েদের উপরেই বেশি পড়ে। সমস্যা দেখা দেয় ঋতুচক্রেও।

৭, খাবার ঠিক হজম হয় না। তাই গ্যাস্ট্রিক সহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা যায়।

থাইরয়েড টেস্ট

আমরা আগেই থাইরয়েডের লক্ষণগুলো নিয়ে আলোচনা করেছি। তাই আপনার মধ্যে এই লক্ষণগুলো দেখা দিলে বা এর যে কোন একটি দেখা দিলেও আপনি থাইরয়েড পরীক্ষা করতে পারেন। আমরা আপনাদের থাইরয়েড টেস্ট পদ্ধতি সম্পর্কে জানাবো।

থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যক্ষমতা জানতে, থাইরয়েড ফাংশন টেস্ট করাতে হবে। এটি রক্ত পরীক্ষার একটি সিরিজ। এর উপলব্ধ কিছু টেস্ট রয়েছে। সেগুলো হলো, T3, T4, TSH ও অন্যান্য কিছু টেস্ট।

সতর্কতা

থাইরয়েড ফাংশন টেস্টের পূর্বে আপনি যদি বিশেষ কোন ওষুধ গ্রহণ করে থাকেন, তাহলে সেটি অবশ্যই ডাক্তারকে জানাতে হবে। আপনি গর্ভবতী হলে, সেটিও ডাক্তারকে জানাতে হবে। কিছু ওষুধ এবং গর্ভবতী হলে থাইরয়েড টেস্টের ক্ষেত্রে ভুল রিপোর্ট আসতে পারে।

টেস্ট পদ্ধতি

এই টেস্টটি কোন ল্যাব অথবা ডাক্তারের কার্যালয়ে হয়ে থাকে। প্রথমে পরীক্ষার সময় একটি চেয়ারে বসিয়ে অথবা টেবিলে শুইয়ে রক্ত নেওয়া হয়।

ডাক্তার বা নার্স আপনার শরীরে সুই ঢুকিয়ে রক্ত নিবেন। রক্ত নেওয়া হয়ে গেলে এটি একটি টিউবে সংগ্রহ করে, সেটাকে পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়।

ফলাফল

T4 এবং TSH পরীক্ষা সাধারণ ফাংশন টেস্ট। এই দুটি একসাথে করা হয়। T4 পরীক্ষার অপর নাম থাইরক্সিন পরীক্ষা। T4 এর ফলাফল উচ্চ স্তরে থাকলে, এর দ্বারা ওভার এক্টিভ থাইরয়েড নির্দেশ করা হয়।

TSH এর রেঞ্জ 2.0 mlu/L এর উপরে হলে, থাইপোথাইরয়েডিজমের দিকে যাওয়ার ঝুকি থাকে। এর লক্ষণসমূহ আগেই জানানো হয়েছে।

T-4 এবং TSH দুইটি পরীক্ষাই নবজাত শিশুর উপর করা হয়। এর মাধ্যমে স্বল্প কার্যক্রম থাইরয়েড গ্রন্থি সনাক্ত করা হয়।

T3 টেস্ট এর মাধ্যমে ট্রায়োডোথাইরনিন এর মাত্রা পরীক্ষা করা হয়। যদি T4 এবং TSH পরীক্ষাগুলো হাইপোথাইরয়েডিজমের প্রমান করে, তাহলে এটি করা হয়।

প্রতি ডেসিলিটার রক্তে T3 এর স্বাভাবিক পরিসীমা ১০০-২০০ ন্যানোগ্রাম হরমোন। এর স্বাভাবিক উচ্চ মাত্রাকে “গ্রেভ ডিজিজ” বলে।

থাইরয়েড টেস্টে খরচ কত?

থাইরয়েড টেস্ট করতে আমাদের খরচ সম্পর্কেও ধারণা থাকা উচিত। এটি পরীক্ষা করতে সাধারণত ৫০০-১০০০ টাকা লাগতে পারে। তবে স্থানভেবে এটির ভিন্নতা রয়েছে। এমারজেন্সি করালে বেশি খরচ লাগতে পারে।

থাইরয়েড টেস্ট করাতে ১০ মিনিটের মতো সময় লাগে। তবে রক্ত সংগ্রহ, পরীক্ষা করা লোকের অভিজ্ঞতার কারণে সময় বেশি বা কম লাগতে পারে।

পড়ুন এম আর আই কি কি রোগ নির্ণয় করে? MRI মেশিন খরচ

থাইরয়েড সমস্যা থেকে মুক্তির উপায়

যারা থাইরয়েড সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে চান, তারা কিছু পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারেন।

১, বাইরের প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং জাঙ্ক ফুড
পরিহার করতে হবে। কেননা এসব খাবারে চর্বি, লবণ, কার্বনেটসহ ক্ষতিকারক উপাদান বেশি থাকে। যা ওজন এবং স্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর।

২, অগোছালো জীবনযাপন পরিহার করে নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন করতে হবে। স্বাস্থ্য ভালো রাখতে নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। শরীরের অতিরিক্ত ক্যালোরি কমাতে ও শরীর সুস্থ রাখতে নিয়মিত ব্যায়াম শরীরের জন্য বিশেষ উপকারী।

৩, খাওয়ার সময় মনোযোগ দিয়ে ভালো করে চিবিয়ে খেতে হবে। এতে করে থাইরয়েড এবং মনের মধ্যে সংযোগ গড়ে তুলবে। তাই খাওয়ার সময় তাড়াহুড়ো না করে, সময় নিয়ে ভালো করে চিবিয়ে খেতে হবে। শরীরের বিপাক নিয়ন্ত্রণে থাইরয়েড গ্রন্থি বিশেষ ভূমিকা পালন করে, সে জন্য সময় নিয়ে খাবার চিবিয়ে খেলে তা বিপাক ক্রিয়া বাড়াতে বিশেষভাবে সাহায্য করে।

৪, বাঁধাকপি, ব্রকলি, ব্রাসেলস স্প্রাউট, ফুলকপি জাতীয় শাক-সবজি কাঁচা অবস্থায় না খেয়ে, ভালভাবে সিদ্ধ করে খেতে হবে। এগুলো কাঁচা অবস্থায় খেলে থাইরয়েড গ্রন্থির কাজে ব্যাঘাত ঘটায় এবং থাইরয়েড গ্রন্থির ভারসাম্য নষ্ট করে।

৫, হরমোন উৎপাদনের ভারসাম্যতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে অ্যাপেল সিডার ভিনেগার অনেক উপকারী। এতে বিপাক ক্রিয়ার উন্নতি হয়। এটি শরীরের ফ্যাট’ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। পাশাপাশি শরীর থেকে বিভিন্ন বিষাক্ত পদার্থ বের করে পুষ্টি শোষণে সহায়তা করে। তাই অ্যাপেল সিডার ভিনেগার ব্যবহার করতে হবে।

৬, থাইরয়েডের সমস্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য ভিটামিন বি সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে ভিটামিন বি১২ হাইপোথাইরয়েডিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য অত্যন্ত উপকারী। তাই যেসব খাবারে এই ভিটামিন বেশি থাকে, সেগুলো প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তাহলে এগুলি শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন বি সরবরাহ করতে পারবে।

৭, ভিটামিন ডি এর অভাব থাইরয়েডের সমস্যা তৈরী করতে পারে। তাই শরীরে পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি এর চাহিদা পূরণ করতে হবে। সূর্যের আলো থেকে শরীর ভিটামিন ডি প্রস্তুত করতে পারে। তাই দিনে অন্তত পক্ষে ১৫ মিনিট সূর্যের আলোয় থাকতে হবে। এতে শরীরে ভিটামিন ডি প্রস্তুতসহ ভালোভাবে ক্যালসিয়ামের শোষণ হবে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়বে।

পাশাপাশি কিছু খাবার খাওয়া যেতে পারে। যেমন- স্যালমন, ম্যাকারেল, দুগ্ধজাতীয় দ্রব্য, কমলালেবুর রস, ডিমের কুসুম ইত্যাদি।

৮, আয়োডিন ও খনিজসমৃদ্ধ খাবার থাইরয়েডের জন্য অনেক বেশি উপকারী। তাই যে খাবারে এই উপাদানগুলো বেশি থাকে যেমন, দুধ, পনির, দই এই ধরনের দুগ্ধজাতীয় খাবার থাইরয়েডের জন্য অনেক বেশি উপকারী।

থাইরয়েডের চিকিৎসা পদ্ধতি

খাবারের দিকে খেয়াল রাখলে থাইরয়েড থেকে দূরে থাকা যায়। তবে থাইর‍ইয়েড সমস্যা হলেও এর চিকিৎসা সম্ভব। থাইরয়েডের চিকিৎসা যেকোন চিকিৎসার চেয়ে অনেক সহজ। যদিও হাইপো থাইরয়েডে সারা জীবন ওষধ খেতে হয় অথবা হাইপার থাইরয়েডে টিউমার অ্যাবলেশান করলে আবার তা হাইপো হয়ে যায় সে জন্য দেখা যায় দুই ক্ষেত্রে লম্বা সময় চিকিৎসা নিতে হয়। তবুও এর খরচ খুব কম। প্রতিদিন মাত্র একটা বা দু’টা ওষধ খেলেই সুস্থ থাকা যায়, যার মূল্য এক থেকে দুই টাকা মাত্র। সেইসাথে ফুড সাপ্লিমেন্ট তো নেয়াই যায়।

থাইরয়েড রোগীদের ক্যালসিয়ামের অভাব হয়, ইউরিক এসিড বেড়ে যাওয়া সহ কিছু ভিটামিন্স মিনারেলের অভাব হয়, বিশেষ করে রক্ত কমে যেতে পারে এজন্য কিছু শাক সবজি যদি খাবারের সাথে রাখা যায় এটাও একটা চিকিৎসার অংশ। আর থাইরয়েড রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি অবশ্যই খুবই সস্তা এবং সারা জীবন নেওয়ার মত। প্রতিদিন সকালে খালি পেটে আপনার প্রয়োজন মত ওষুধ খেয়ে নিবেন। আর প্রেগনেন্সির ক্ষেত্রে টেবলেটের পরিমাণ একটু বেশি প্রয়োজন হয়। এটা সবসময় খেয়াল রাখতে হবে। এই টেবলেটগুলো খুবই সহজলব্য গ্রাম থেকে শুরু করে সব জায়গায় সহজেই পাওয়া যায়। কারণ এই টেবলেটগুলো আমাদের দেশেই তৈরি হয়।

উপসংহার

আমাদের উচিত নিয়মিত আয়োডিন যুক্ত খাবার খাওয়া। এতে আমরা সুস্থ এবং স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবো।

Leave a Comment