পুনরায় খাবার গরম করে খেলে হতে পারে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি
খাবার তো খান, কিন্তু জানেন কি কিছু খাবার পুনরায় গরম করে খেলে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি হতে পারে
আপনি কি টাটকা খাবার খেতে অভ্যস্ত নাকি বাসি খাবার? যদি বাসি খাবার খেতে অভ্যস্ত হয়ে থাকেন, কখনও কি ভেবে দেখেছেন তা আদৌ আপনার শরীরের জন্য বিরূপ প্রভাব ফেলবে কি না?
আধুনিকতার এই যুগে একেক সময়ে খাবার গরম করে খাওয়াটা কোনো ব্যাপার ই না। কিন্তু, এর ফলে আপনার শরীরের যে কতোটা ক্ষতিসাধন হতে পারে তা জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারন খাবার একবার রান্না করার পর তা পুনরায় গরম করলে অনেকসময় খাবারের পুষ্টিগুণ নষ্ট হয়ে যায়। এমনকি খাবারের প্রোটিন ও নাইট্রেট ভেঙে যায়, যা আমাদের প্রিয় খাদ্যকে বিষাক্ত করে তোলে। যার দরুন বিভিন্ন ধরনের সমস্যা যেমনঃ বদহজম, বমি,জ্বর,পেট খারাপ, ডায়রিয়া এমনকি ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ও থাকে।
পুনরায় যেসব খাবার গরম করে খেলে হতে পারে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি।
রান্নার পর এই খাবারগুলো গরম করবেন না;
১. ডিমঃ
ডিমকে বলা হয়ে থাকে প্রোটিনের পাওয়ার হাউস। আবার, এতে থাকে অ্যান্টি অক্সিডেন্টস। কিন্তু, যদি ডিমকে একবার রান্না করার পর ২য় বার তাপমাত্রার সংস্পর্শে আনা হয় তাহলে ডিমে থাকা প্রোটিনগুলো ভেঙে যায় এবং এই ভেঙে যাওয়ার ফলে স্যামোনিলা নামের ব্যাকটেরিয়া জন্মানো শুরু করে। পাশাপাশি ডিমের মধ্যে থাকা নাইট্রোজেন অক্সিডাইজড হয়, যা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই পুষ্টিবিদদের মতে, ডিম রান্না কিংবা ভাজা যেভাবেই খান না কেনো কোনোটাই ২য় বার গরম করে খাওয়া ঠিক নয়।
পার্শপ্রতিক্রিয়াঃ
বদহজম,জ্বর,পেটে ব্যাথা ও ডায়রিয়া।
২. ভাতঃ
ব্রীটেনের ‘ফুড স্ট্যান্ডার্ড এজেন্সি ‘র গবেষণা অনুসারে,ভাত রান্নার পর যদি ১ ঘন্টা অতিক্রম হওয়ার পরও তা সাধারন তাপমাত্রায় রাখা হয় তাহলে সেখানে ‘ব্যাসিলাস সিরিয়াস‘ নামক এক প্রকার ব্যাকটেরিয়া তৈরি হতে থাকে। ওই রেখে দেওয়া ভাত পুনরায় গরম করলেও ব্যাকটেরিয়াগুলো নষ্ট হয় না। বরং ব্যাক্টেরিয়ার স্পোরগুলো বংশবিস্তার করতে থাকে এবং এক পর্যায়ে এন্টেরোটক্সিন উৎপন্ন করতে পারে যা খাবারে বিষক্রিয়া করতে পারে।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াঃ
বমি ও ডায়রিয়া।
বিকল্পঃ
যেহেতু, বাঙালির প্রধান খাদ্য ভাত, তাই যখন হমৃখাওয়ার সময় হবে তার কিছুক্ষন আগে আপনারা রান্না করে নিতে পারেন। যদি তা সম্ভব না হয়, ভাত ফ্রিজে রেখে খাওয়ার কিছুক্ষন আগে বের করে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় এলে খেতে পারেন। আর এটাও মনে রাখতে হবে যে, কখনই ফ্রিজে ভাত ১ দিনের বেশি রেখে খাবেন না।
৩. পোড়াতেলঃ
আমরা অনেকেই খাবার রান্না বা ভাজা শেষে অবশিষ্ট তেল রেখে দেই পরবর্তী কোন খাবার রান্নার জন্য। যখন কোনো কিছু ভাজার জন্য তেল বেশি গরম করা হয় তখন তেলের গঠন পরিবর্তন হয় এবং এতে বিষাক্ত উপাদান তৈরি হয়।
এ তেল হৃদযন্ত্রের জন্য খারাপ। রক্তে বাজে কোলেস্টেরল অর্থাৎ অ্যাথেরোসক্লেরোসিস তৈরির জন্য এই তেল দায়ী। তাই রাস্তার পাশে বা ফুটপাতের খাবার খাওয়া এড়িয়ে চলুন।
কারণ বেশিরভাগ ফুটপাতের খাবার পোড়াতেল দিয়ে তৈরিকৃত। পাশাপাশি বাড়িতেও পোড়াতেল দিয়ে রান্নার অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াঃ
অ্যাসিডিটি,বুক জ্বালাপোড়া, আলৎঝাইমার’স রোগ,পার্কিনসন’স রোগ, গলায় অস্বস্তি হতে পারে।
এছাড়াও ১বার ব্যবহৃত তেল আবার রান্নায় ব্যবহার করলে যে মুক্ত মৌল তৈরি হয় তা থেকে কারসিনোজেনিক অর্থাৎ ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
বিকল্পঃ
যেকোনো কিছু রান্না করার ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয় একটি উপকরণ হলো তেল।
- রান্নার পর অবশিষ্ট তেল ঠান্ডা করে ছেঁকে বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করতে পারেন। ছেঁকে নেয়ার ফলে তেলের মধ্যে খাবারের অবশিষ্টাংশ অপসারিত হবে, যা তেলটুকুকে দ্রুত নষ্ট করতো।
- পোড়া তেল পুনরায় ব্যবহারের আগে লক্ষ্য করবেন,তেলের রং যদি গাঢ় হয়ে যায়, স্বাভাবিকের চাইতে বেশি ঘন, আঠালো হয় এবং তুলনামূলক ভাবে বেশি ধোঁয়া হয় তবে তা ব্যবহার করা যাবে না, ফেলে দিতে হবে।
৪. মুরগির মাংসঃ
ই.কোলি থেকে সালমোনেলার মতো নানা ব্যাক্টেরিয়া দ্রুত মুরগির ওপরে বাড়তে শুরু করে। তাই মুরগি যদি ঠিকমতো রান্না বা সংরক্ষণ করা না হয়, তবে মুরগি খাওয়া বিপজ্জনক।
মুরগির মাংস পুনরায় গরম করলে, মুরগির মাংসে থাকা প্রোটিনের বৈশিষ্ট্য পরিবর্তনশীল হয়।
প্রোটিনের পরিবর্তিত বৈশিষ্ট্য অ্যামাইনো ও মাংসে থাকা নাইট্রেট কে একত্রিত করে নাইট্রোসেমিন তৈরি করে যা ক্যান্সার হওয়ার কারণ হিসেবে বিবেচিত।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াঃ
হজমজনিত সমস্যা এমনকি ক্যান্সার ও সৃষ্টি করতে পারে।
বিকল্পঃ
খাওয়ার পর যদি কিছুটা রয়ে যায়, তবে তা ফ্রিজে রেখে দিন। খাওয়ার আগে নামিয়ে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় এলে খেতে পারেন। আর গরম করে যদি খেতেই হয় তবে চুলায় অল্প আচে একটু বেশি সময়ের জন্য গরম করে নিন।
৫. আলুঃ
পুষ্টিগুণে ভরপুর আলু যদি একবার রান্না করার পর বেশি সময় ধরে ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রাখা হয় তাহলে, এর পুষ্টিগুণ নষ্ট হয়ে যেতে শুরু করে। পুনরায় গরম করা হলে তা স্বাস্থ্যঝুকি বাড়ায়।
আলুতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট ও তাপ সংবেদনশীল ভিটামিন, যেমনঃ ভিটামিন বি কমপ্লেক্স ও ভিটামিন সি ।
পুনরায় গরম করার ফলে এই ভিটামিনগুলোর মাত্রা কমে যায়। আবার, বটুলিজম (বিরল এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া) উৎপন্ন হতে পারে।
যখন ২ ঘন্টার চেয়ে বেশি সময় ধরে রান্না করা আলু ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় থাকে, তখন ব্যাক্টেরিয়ার প্রজননস্থল কার্যকরী হয়ে যায়। সেই সঙ্গে ফুড পয়েজনিং হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াঃ
মাথা ঘোরানো,অসুস্থতা, পেট খারাপ, হজমশক্তিতে ব্যাঘাত, শ্বাস-প্রশ্বাস জনিত রোগ এবং পেশিবহুল পক্ষাঘাত ও হতে পারে।
৬. পালং শাকঃ
পালংশাকে রয়েছে প্রচুর পরিমানে আয়রন ও নাইট্রট । রান্না করা পালংশাক পুনরায় গরম করলে এই নাইট্রট ভেঙে নাইট্রাইটস ও অন্যান্য ক্যান্সার সৃষ্টিকারী পদার্থের জন্ম দেয়। এই যৌগ গুলো মেথেমোগলোবিনেমিয়ার উপস্থিতি ঘটায়, যা শরীরে অক্সিজেনের মাত্রায় প্রভাব ফেলে। এই নাইট্রাইটসগুলো নাইট্রোসেমিনে রূপান্তরিত হতে পারে।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াঃ
পেট খারাপ, ক্যান্সারের ঝুঁকি।
বিকল্পঃ
পুনরায় গরম করে যদি খেতেই হয়, তবে রান্নার পরপরই ঠান্ডা করে নিতে হবে ।
৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে তাপমাত্রায় রেখে সংরক্ষণ করতে হবে। এতে করে নাইট্রটকে নাইট্রোসেমিনে রূপান্তরিত হওয়ার বিষয়টি প্রতিরোধ করা যাবে।
৭. চাঃ
দৈনন্দিন জীবনে যে কোনো সময়ই আমরা চা পান করে থাকি।
কিন্তু, অনেকেই চা একবার বানানোর পর তা ঠান্ডা হয়ে গেলে পুনরায় গরম করে পান করে যা একদমই ক্ষতিকর। কারণ চায়ের মধ্যে ট্যানিক অ্যাসিড থাকে।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াঃ
লিভারের ক্ষতি হতে পারে।
বিকল্পঃ
চা বার বার গরম করে খাওয়ার অভ্যাস ত্যাগ করে চা ফ্লাক্সে রাখতে পারেন।
৮. মাশরুমঃ
সাধারণত মাশরুমের ফাইবার ও এনজাইম হজমে সহায়তা করে। এটি অন্ত্রে উপকারী ব্যাকটেরিয়ার কাজ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে । এবং কোলন এর পুষ্টি উপাদান শোষণকে ও বাড়াতে সাহায্য করে। মাশরুম পুনরায় গরম করলে মাশরুমে থাকা প্রোটিনগুলো নষ্ট হয়ে যায় এবং পুষ্টিগুলো এর গুণাগুণ হারিয়ে ফেলে।
পাশ্বপ্রতিক্রয়াঃ
বদহজম ও হৃদরোগজনিত সমস্যা হতে পারে।
বিকল্পঃ
রান্নার পরপরই মাশরুম খেয়ে নেয়া ভালো। যতটুকু খাবেন ততটুকুই রান্না করুন। যদি ফ্রিজে রাখাও হয় তবে খাওয়ার আগে নামিয়ে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় এলে খান।
৯. রোস্ট করা লাল মাংসঃ
রোস্ট করা লাল মাংস ২য় বার গরম করলে এর প্রোটিনের রাসায়নিক কাঠামো এমনভাবে বদলে যায় যে, তা আমাদের হজম প্রক্রিয়ায় সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
১০. সেলারি, বিট এবং স্পিনাকঃ
এই ৩টি সবজিতে একটি কমন উপাদান আছে যা হলো – নাইট্রেট । যা ২য় বার গরম করলে ক্ষতিকর নাইট্রাইটস পরে নাইট্রোস্যামিনস এ রূপান্তরিত হতে পারে। নাইট্রোস্যামিনসদের কয়েকটি কার্সিনোজেনিক হিসেবে পরিচিত।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াঃ
পেট খারাপ,বদহজম এমনকি ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে।
বিকল্পঃ
সেলরি, বিট এবং স্পিনাক এই তিনটি সবজি ফ্রিজে রেখে নিয়মানুযায়ী খেতে পারেন। আর স্যুপে যদি সেলরি ও মাংস দিয়ে থাকেন তাহলে ২য় বার গরম করার আগে, সেলরি ও মাংস ফেলে দিয়ে তারপর গরম করে নিন।
যেহেতু, স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল তাই সুস্থ ও কর্মক্ষম থাকতে আমাদেরকে উল্লেখিত বিষয়গুলো মেনে চলার চেষ্টা করতে হবে।
পেরিয়ড পেট ব্যথা কারণ এবং করণী সমন্ধে জানুন
বিজ্ঞান নিউজ পেতে এই সাইটেও ভিজিট করতে পারুন
লেখা;
সুমাইয়া
পুনরায় খাবার গরম