কারাগারের রোজনামচা সারমর্ম। বঙ্গবন্ধু। বই রিভিউ

কারাগারের রোজনামচা সারমর্ম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রাহমান

“কারাগারের রোজনামচা ” আমরা বঙ্গবন্ধুর কারাগারের জীবনযাপন সম্পর্কে ব্যাপক জানতে পারবো। জেলখানার জীবন কেমন হয়, আমরা বাইরে থেকে যেমন দেখি, যেমন টা ভাবি জেলখানার জীবন, বাস্তব জীবনে জেলখানার জীবন সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমরা যারা সাধারণ মানুষ, তারা অনেক কিছু জানতে পারবো বইটি পড়ে। বঙ্গবন্ধু কারাগারে কিভাবে জীবনযাপন করেছেন, কিভাবে সময় অতিবাহিত করেছেন, কতো হতাশা, উৎকন্ঠার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন তা আমরা জানতে পারবো বঙ্গবন্ধুর “কারাগারের রোজনামচা বইটি “পড়ে।

‘কারাগারের রোজনামচা’ বইটি মূলত বঙ্গবন্ধুর কারাগারে থাকাকালীন দৈনন্দিন লিখিত ডায়েরি।

বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী বঙ্গবন্ধুকে সবসময় অনুপ্রেরণা দিয়েছেন ডায়েরি লিখতে। বঙ্গবন্ধু যতবার বন্দি হয়েছেন ততোবার তিনি বঙ্গবন্ধুকে কাগজ কলম কিনে দিয়ে এসেছেন জেলখানায়। বঙ্গবন্ধুর অলস সময় কাটানোর জন্য বঙ্গবন্ধুও লেখালিখি, বই, পত্রিকা, মাঝে মাঝে রান্না ও করতেন। বঙ্গবন্ধুর ডায়েরি তে ফুটে উঠেছে পরিবার পরিজন ছেড়ে একা জেলখানায় বন্দি হয়ে থাকা কতোটা কষ্টের। চিঠিই ছিলো একমাত্র ভরসা। মাঝে মাঝে দেখা করতে আসতেন পরিজন৷ জেলখানার বন্দি ছোট শিশুদের কে দেখে বঙ্গবন্ধু তাঁর সন্তানদের কথা মনে করতেন। তাঁর সন্তানরা তাঁর অভাব যে সবসময় অনুভব করতেন, তা বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারতেন, এবং এই কষ্টের অনুভূতি হচ্ছে সবচেয়ে খারাপ অনুভূতি। জেলখানার রান্না খুবই বাজে।

কারাগারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দুর্বিষহ জীবন

বঙ্গবন্ধুর জীবন কতোটা দুর্বিষহ হয়ে পড়েছিল জেলখানায় তা আমরা জানতে পারবে ‘কারাগারের রোজনামচা ‘ বইটি পড়ে। বইটিতে ১৯৬৬ সালের ছয় দফার দাবি ফুটে উঠেছে । ছয় দফা ছিলো বাঙালির প্রাণের দাবি। ছয়দফার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিল। কারণ পশ্চিম পাকিস্তানিরা নিজেদের মধ্যে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছিল। কারাগারের মধ্যে থেকেও বঙ্গবন্ধুর দেশের মানুষের মঙ্গলের কথা ভেবেছে। দেশের মানুষের কথা ভাবতে ভাবতেই তার সময় গড়াতো। জেলখানার ভেতর কিছু পত্রিকা পড়ে বঙ্গবন্ধু দেশের কিছু খবর জানতে পারতো। কিন্তু পত্রিকা গুলোতে সব খবর প্রকাশিত হতো না। কারণ সংবাদপত্রের কোন স্বাধীনতাই ছিলো না। বঙ্গবন্ধু বারবার বলেছেন আর দুঃখ প্রকাশ করেছেন কারণ স্বাধীন দেশে বসবাস করেও যখন পত্রিকা গুলো স্বাধীনভাবে লেখালেখি করতে পারে না, এর চেয়ে বড় দুঃখ আর কি হতে পারে। তার মধ্যে যখন ইত্তেফাক পত্রিকা বন্ধ করে দেয় সরকার, তখন বঙ্গবন্ধুর মন আরো খারাপ হয়ে যায়। কারণ ইত্তেফাক পত্রিকা এর সাথে বঙ্গবন্ধুর সবসময় জড়িত ছিলেন।

জেলখানায় অনেক সেল, দফা রয়েছে যা বঙ্গবন্ধু জানতো না।

তাছাড়া জেলখানার ভেতরের মানুষজন তাদের মতো করে বিভিন্ন শব্দ বানিয়ে নিয়েছে। প্রথম প্রথম কেউ জেলখানায় আসলে, এসব ভাষা বুঝতেই পারবে না। বঙ্গবন্ধু প্রথমে এসব ভাষা বুঝতে না পারায় জেলখানার অন্যান্য কয়েদিরা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে হাসি ঠাট্টায় মেটে উঠায় বঙ্গবন্ধুর লজ্জা পেয়েছিলেন। সময়ের সাথে সাথে বঙ্গবন্ধু সেসব ভাষাও শিখে ফেলে। শব্দগুলো ছিলো এমন – রাইটার দফা, চৌকি দফা, জলভরি দফা, ঝাড়ু দফা, পাগল দফা, বন্দুক দফা, শয়তানের কল, দরজি খাতা, আইন দফা, ডালচাকি দফা, হাজতি দফা, ছোকরা দফা। এই শব্দগুলো দিয়ে কয়েদিরা কি বোঝায় তা জানতে বইটি আপনাকে পড়তে হবে। শব্দগুলো শুনতে খুব মজার।

জেলখানার বিভিন্ন কারবার মাঝে মাঝে আপনাকে হাসাবে।

আবার কিছু কিছু ঘটনা আপনাকে কাঁদতে বাধ্য করবে। বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন কয়েদির সাথে কথা বলে জানতে পারে সমাজের আসল রুপ। এক কয়েদির সাথে কথা বলে বঙ্গবন্ধু জানতে পারে যে, এই কয়েদি একজন চোর ও পকেটমার। বার বার ধরা পড়েছে, জেল হয়েছে, ছাড়া পেয়েছে তারপর আবার সেই একই চোরকারবারের সাথে জড়িয়ে গেছে। দারোগা সাহেবকে দু’ পয়সা দিয়েই হাত করে নিতো সেই কয়েদি। জেল তার কাছে ডালভাত হয়ে গেছিলো। কিন্তু হঠাৎ করে একদিন এমনভাবে ফেঁসে গেলো যে কয়েকবছরের জেল হয়ে গেলো। আবার জেলখানায় পাগলরাও আটক হয়। তারা কেউ জেলখানায় আসার পরে পাগল হয়েছে, আবার কেউ প্রিয়জন কে খুন করে পাগল হয়ে গেছে।

কারাগারে বঙ্গবন্ধুর দিনকাল

একবার এক পাগল অন্য পাগলদের কে পাগল বলে সম্বোধন করায় বঙ্গবন্ধু হেসেছিল আর মনে মনে বলছিলো, সে নিজে যে পাগল সেটাই ভুলে গেছে। মাঝে মাঝে পাগলদের পাগলামির জন্য বঙ্গবন্ধু রাতে ঘুমাতে পারতো না। কেউ কেউ হঠাৎ করে গান বাজনা শুরু করে দিতো, কেউ কেউ চিৎকার করে উঠতো। এদের জন্য ও বঙ্গবন্ধুর মায়া হতো। একবার অনেকগুলো বাচ্চা ছেলেদের আটক করে আনে জেলখানায়। বঙ্গবন্ধুর খুবই খারাপ লাগছিলো বাচ্চা ছেলেদের কে দেখে।

কিছুদিন পরে যখন তারা ছাড়া পেলো তখন বঙ্গবন্ধুকে বলে, “স্যার, আমরা চলে যাচ্ছি, আপনাকে বের করার জন্য আমরা আন্দোলন করবো”।বঙ্গবন্ধু সেদিন এতো আনন্দিত হয়েছিলো! বঙ্গবন্ধুর জীবন স্বার্থক মনে হচ্ছিল। বঙ্গবন্ধু জেলে বসেই বাঙালি জাতির কি হয়, বাংলার কি হয়, এসব নিয়ে সবসময় উৎকন্ঠায় থাকতেন। তার সাথে পরিবারের সাথে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কষ্ট, জেলখানায় একা একা কোন কথা বলার সঙ্গী ও ছিলো না, কি সীমাহীন যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে গিয়েছে বঙ্গবন্ধুর কারাগারের জীবন তা আমরা বইটি পড়লেই অনুধাবন করতে পারবো৷ বাঙালি জাতিকে যে স্বাধীনতা এনে দিলো, সেই মানুষটির কারাগারের জীবন সম্পর্কে জানা প্রত্যেকটি বাঙালির নৈতিক দায়িত্ব।

বইটির মোট পৃষ্ঠা -৩৩২।

মূল্য -৪০০ টাকা মাত্র

আরো পড়ুন অসমাপ্ত আত্মজীবনী বই রিভিউ

Leave a Comment