আমার দেখা নয়াচীন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
আমার দেখা নয়াচীন
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসে পিস কনফারেন্স অব দি এন্ড প্যাসিফিক রিজিওন্স এ পাকিস্তান প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে নয়াচীন ভ্রমণ করেন। ১৯৫৭ সালে পূর্ব-বাংলার শ্রমমন্ত্রী থাকাকালে তিনি আবার চীন ভ্রমণ করেন। মূলত তার চীন ভ্রমণের ভ্রমণকাহিনী নিয়েই গড়ে উঠেছে “আমার দেখা নয়াচীন ” বই টি। বই টিতে শুধু নয়াচীনের ভ্রমণ কাহিনীই নয় বরং তৎকালীন চীনের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক সর্ববস্থার সামগ্রিক দিক ফুটে উঠেছে।
১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পিকিং এ শান্তি সম্মোলনে ৩৭ টি দেশের যোগদানে- পাকিস্তানের পক্ষে বঙ্গবন্ধু সহ আরো পাঁচজন রৌওনা হয় নয়াচীনের উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে ব্রহ্মদেশ সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া যায়। জানা যায় ব্রহ্মদেশের অবস্থা খুবই খারাপ। বিপ্লবীরা বহুস্থান দখল করে আছে, আর মাঝে মাঝেই রেঙ্গুন শহরে পানি বন্ধ করে দেয় এবং দিনে দুপুরে ডাকাতিও ঘটে।
নয়াচীনের উদ্দেশ্যে প্রথমে বঙ্গবন্ধুরা হংকংয়ে পৌঁছে
হংকংয়ের কোলন হোটেলে তাদের কে রাখা হয়। হংকং এ ঘুরতে বের হয়ে পরে বঙ্গবন্ধু, আতাউর রহমান, জনাব মানিক, ইলিয়াস । হঠাৎ ১৬/১৭ বছরের এক মেয়ে আতাউর রহমান সাহেবের কোটে একটা গোলাপ ফুল বুঝে দেন। আতাউর রহমান চমকিয়ে যান, সবাই হাসাহাসি শুরু করে। আসল ঘটনা হচ্ছে হংকং এ ফুল দেওয়াটা হলো প্রেম নিবেদন। ফুলটা গ্রহণ করলেই ওরা মনে করবে আপনি তার সাথে যেতে রাজি। এটাই ছিল তখন হংকং এর সমাজব্যবস্থা। বাঁচবার জন্য তারা ইজ্জত দিয়ে পেটের ভাত জোগাড় করছে।
বঙ্গবন্ধু লক্ষ করেন যে হংকং এ প্রায় সব কিছু পাওয়া যায়
জিনিসপত্র ও খুব সস্তা। তারপরে ট্রেনে যাত্রাকালীন বঙ্গবন্ধু জানতে পারেন যে কেউ টিকিট ছাড়া ভ্রমন করে না, কোন কারচুপির সুযোগ নাই। যা শুনে বঙ্গবন্ধু খুবই অভিভূত হলেন। বঙ্গবন্ধুর লেখনিতে চীন দেশের সৌন্দর্য দারুণ ভাবে ফুটে উঠেছে। বঙ্গবন্ধুর কাছে অনেকটা পূর্ববাংলা তথা বাংলাদেশের মতো মনে হয়েছে। যেমন সবুজ ধানের ক্ষেত, চারদিকে বড় বড় গাছ, মাটির ঘরের গ্রাম, ছোট ছোট নদী, যে রুপে বঙ্গবন্ধু হারিয়ে যাচ্ছিলো বার বার।
ট্রেন থেকে নেমে ক্যান্টন পৌঁছালো। নামার সাথে সাথেই ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা লাইন করে দাড়িয়ে ফুলের তোড়া দিয়ে স্বাগতম জানালো। চীনাবাসীর আথীয়তায় বঙ্গবন্ধু মুগ্ধ হয়ে যান। তার পরে পিংকিং এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা, পিংকিং এর শ্রেষ্ঠ হোটেলে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়।
শান্তি সম্মোলন শুরু হলো
বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি গণ তাদের দেশের অবস্থা সম্পর্কে জানালেন। নর্থ কোরিয়ার ডেলিগেটরা জানালেন কীভাবে তাদের উপর জীবাণু বোমা ছেড়েছে আমেরিকানরা। জাপান বললো ‘লক্ষ লক্ষ জারজ সন্তান পয়দা করেছে আমেরিকানরা। তাদের হাতে আমাদের মা -বোনদের ইজ্জত পর্যন্ত নষ্ট হয়ে গেছে। ” আমেরিকা থেকে একজন নিগ্রো নেতা জানান কিভাবে তাদের উপর অত্যাচার করা হয়। ভারতীয় দল থেকে বলা হয় ‘ভারতের জনগণ শান্তি চায়’। এভাবে সকল দেশের নেতারা বক্তৃতা করলেন। কয়েকদিন শুধু বক্তৃতাই হলো। মাঝে মাঝে থিয়েটার, নাচ হতো, গান হতো। বঙ্গবন্ধু তা দেখতে যেতেন। এভাবে সম্মোলন এগারো দিন চলতে থাকে।
অনেক দেশের প্রতিনিধিদের সাথে বঙ্গবন্ধুর আলাপ হয়। অনেক দেশই পাকিস্তান কে চেনেন না তখন বঙ্গবন্ধু খুবই আশ্চর্য হন। তখন বুঝতে পারেন পাকিস্তান সম্পর্কে দুনিয়ায় তেমন প্রচারণা নাই। বঙ্গবন্ধুর কাছে যেটা সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে সেটা হলো চীনাদের মাতৃভাষার প্রতি মমত্ববোধ। কারণ চীনারা ইংরেজি জানা স্বত্তেও কেউ ই তাদের মাতৃভাষা ছাড়া কথা বলেন নাই। যার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু চীনাদের জাতীয়তাবোধ সম্পর্কে ধারণা পান। বুঝতে পারেন চীনাদের দেশ ও মাতৃভাষার প্রতি কতো দরদ।
তবে কনফারেন্সে বঙ্গবন্ধু যতোটুকু পেরেছেন পাকিস্তান সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন। এমনকি কাশ্মীর যে ভারতবর্ষ জোর করে দখল করে রেখেছে সেটাও ভালোভাবে তুলে ধরেছে।
বঙ্গবন্ধু চীনদেশটাকে নিজের চোখে ঘুরে ঘুরে দেখেছেন। যতোই দেখেছেন ততোই মুগ্ধ হয়েছেন। চীনের শিক্ষা ব্যবস্থা তাকে মুগ্ধ করেছে। যেখানে মুখস্থ ভিত্তিক পড়াশোনা করানো হয় না, এমনকি কৃষি কাজ শিখানোর জন্য আলাদা স্কুল ও আছে তাদের।
তিনি চীনের স্বদেশবোধের পরিচয় পেয়েছেন বার বার। তিনি পিকিং, তিয়ানজিং, নানকিং, ক্যান্টন, হ্যাংচো যতো শহরে ঘুরেছেন কোথাও বিদেশি কোন জিনিস দেখেন নাই।
বঙ্গবন্ধু চীনের স্বাধীনতা দিবস উৎযাপনের চিত্র ও দেখতে পান। চীনারা স্বাধীনতা দিবস খুব ধুমধামে উৎযাপন করে। সবাই তাদের ভালো কাপড় গুলো বের করে পরে।
বঙ্গবন্ধু চীনাদের সততার পরিচয় ও পেলেন, যেমন একদিন একা একা রিকশা চড়ে আসার সময় রিকশাওয়ালা কে কতো টাকা দিবেন সেটা তো তিনি জানেন না। বঙ্গবন্ধু রিকশা ওয়ালাকে বলেন যতো ভাড়া আপনি রেখে দিন। বঙ্গবন্ধু ভেবেছিলো বিদেশী দেখে হয়তো বেশি টাকা রেখে দিবে। কিন্তু পরে দেখতে পেলো একটু ও বেশি রাখেন নি। তাছাড়া বাইরের দেশে প্রচার আছে যে চীনাদের কে ধর্ম পালনে তথা মুসলমানদের নামাজ পড়তে বাঁধা দেওয়া হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু অনেক পর্যবেক্ষণ করে জানতে পারলো চীনা মুসলিম রা তাদের ধর্ম খুব ভালোভাবে পালন করতে পারে। তাদের কোন বাঁধা দেয়া হয় না।
চীন সফরে হঠাৎ একদিন বঙ্গবন্ধু তার বন্ধু মাহবুবের সাথে দেখা পান। বন্ধুস্ত্রী তাকে খুব ভালো করে আহার-আপ্যায়ন করেন। সেই কথাও বঙ্গবন্ধু তার চীনভ্রমণ কাহিনি তে তুলে ধরেছেন।তুলে ধরেছেন চীন থেকে চলে আসার সময় তাঁর খুব খারাপ লেগেছিলো বন্ধুর জন্য। দেশে ফিরে ইচ্ছে করেই আর বেশি যোগাযোগ রাখেন নি কারণ বঙ্গবন্ধু চান না তার কারণে তার বন্ধুর কোন ক্ষতি হোক। এটা থেকে আমরা একজন ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর পরিচয় পাই। যিনি কতোটা সৎ চিন্তার অধিকারী ছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর ভ্রমণকাহিনীতে সাংহাই এর সুন্দর বর্ণণা করা হয়েছে যা দুনিয়ার দ্বিতীয় শহর নামে পরিচিত
সাংহাইয়ে চীনের সবচেয়ে বড় কাপড়ের কল দেখতে পান। শ্রমিক ও মালিকদের মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক দেখতে পান। শ্রমিকদের থাকার জন্য সুন্দর ব্যবস্থা এবং এক শ্রমিক দম্পতির বাড়িতে ঘুরতে গেলে এমন সুন্দর সুন্দর দামী আসবাবপত্র দেখতে পান যা দেখে রীতিমতো তিনি চমৎকৃত হন।
ইংরেজ কর্মচারীদের সাথে নয়াচীনের সম্পর্ক ও বেশ ভালো দেখতে পান। কেউ কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করে না। বরং উভয়ই উভয়ের মন জয় করতে ব্যস্ত।
চীন থেকে বাংলাদেশে ফেরার সময় দোভাষীর বিদায় সাক্ষাত মন ছুয়ে যাওয়ার মতো
দোভাষী বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমা চান কোন অন্যায় করে থাকলে, এবং নিজ দেশ চীনারা সুন্দর ভাবে গড়ে তুলছে, তারা অনেক ভালো আছে সে কথা নিজ দেশকে জানানোর জন্য অনুনয় করেন। বঙ্গবন্ধু ও চীনের জন্য শুভকামনা করেন, খোদার কাছে চীনদেশের মঙ্গল কামনা করেন।
দীর্ঘ পঁচিশ দিনের চীন ভ্রমণে বঙ্গবন্ধু অনেক কিছু দেখেছেন, অনেক কিছু বুঝেছেন, পূর্বের চীন দেশের সাথে বর্তমান চীনের পার্থক্য খুঁজে পেয়েছেন।
যেমন পূর্বে চীন দেশে অনেক ভিক্ষুক থাকলেও বর্তমানে কোন ভিক্ষুক পাওয়া যায় না চীনে। পূর্বে চীন আফিম আর ডাকাতের জন্য বিখ্যাত থাকলেও বর্তমানে তা নির্মূল করা হয়েছে। এসব চুরি ডাকাতির মূল যে বেকারতা তা চীন সরকারের বুঝতে বিলম্ব হয় নাই। তাই নয়াচীন সরকার বেকার সমস্যা দূর করার জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
চীনের অবস্থা ভয়াবহ ছিলো, আইন বলে কোন কিছু ছিলো না
জমিদারদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিলো চীনাসমাজ। এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার জন্য কম্যুনিস্ট পার্টি আবেদন জানালো, তখন মানুষ কম্যুনিস্ট পার্টির দিকে ছুটে চললো। নতুন চীন সরকার কায়েম করলো সুন্দর শাসনব্যবস্থা। তারা সকল কাজে জনগণের সাহায্য নেয়। যেমন একটা রাস্তা করবে তো সকল কে এতে অংশগ্রহণ করতে হবে। প্রত্যেক গ্রামে পঞ্চায়েত প্রথা চালু করে চীনা সরকার। সুন্দর জবাবদিহিতা রয়েছে চীনে। কুটিরশিল্পে অগ্রগতি করছে। কয়েক বছরের মধ্যেই বেকার সমস্যা শতভাগ নির্মূল করবে ধারনা। যেই চীন দেশ বেশ্যাবৃত্তির জন্য বিখ্যাত ছিলো তার বিরুদ্ধে নয়াচীন সরকার জেহাদ ঘোষণা করলো। তবে সেটা আইন করে নয়, মানবিক ভাবে কারণ অনেক মেয়েই পেটের জন্য বেশ্যাবৃত্তি করে জীবীকা নির্বাহ করতো। তার জন্য চীন সরকার ভাবছে এদের পুর্নবাসন করা যায় কিনা।
তাদের কাজের ব্যবস্থা করে দিল চীনা সরকার
যার ফলে বেশ্যাবৃত্তি কমে আসলো। শুধু তাই নয় চীনে কায়েম হয়েছে নারী পুরুষের সমান অধিকার। দুর্নীতি একদম নির্মূল। পূর্বে ধর্মের নামে শোষণ চললেও বর্তমানে সবাই খুব শান্তি ভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করে। তাছাড়া নয়াচীনে কম্যুনিস্ট নীতি বলে কোনো নীতি নাই, দেশ ও জনগণের জন্য যা মঙ্গল তাই তাদের নীতি। এতো অল্প সময়ে চীনদেশের এতো উন্নতি সত্যিই বঙ্গবন্ধু কে মুগ্ধ করেছিলো। তবে একটা দিক বঙ্গবন্ধুর খারাপ লেগেছিলো সেটা হলো নয়াচীনে শুধু কম্যুনিস্টের শাসন। কম্যুনিস্ট মতবাদ ছাড়া অন্য কোন মতবাদের লোককে রাজনীতি করতে দেয় না। বঙ্গবন্ধুর মনে হয়েছিলো সকল মতবাদের মানুষ কেই রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া উচিত কারণ প্রত্যেক মানুষেরই নিজের মতবাদ প্রকাশ করার অধিকার থাকা উচিত।
তবে যাই হোক বঙ্গবন্ধুর চীন ভ্রমণে তিনি আন্দাজ করতে পেরেছিলেন এই চীন অনেক উন্নতি করবে, এবং শেষে তার আন্দাজ বাস্তবে পরিপূর্ণ হতে আমরা দেখেছি। এ থেকে বুঝা যায় বঙ্গবন্ধু কতো দূরদর্শী ছিলেন। তিনি শুধু চীন ভ্রমণ ই করে নি বরং প্রত্যেকটা ঘটনা নিজ বুদ্ধি দিয়ে বিবেচনা করেছেন, অবলোকন করেছেন নয়াচীনের ভবিষ্যত।
আমার দেখা নয়াচীন বইয়ের শেষে বঙ্গবন্ধুর নয়াচীন ভ্রমণের কিছু আলোকচিত্র সংযোজন করা হয়েছে যা চীনের মহামান্য রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কে উপহার হিসেবে দিয়েছেন যা বইটিকে অনেক প্রাণবন্ত ও তথ্যবহুল করে তুলেছে।
বঙ্গবন্ধুর চোখে চীনকে বুঝতে হলে, দেখতে হলে তথা ইতিহাসের শিক্ষার্থী থেকে সর্বস্তরের জনগণকে, বিশেষ করে অনার্স পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের অবশ্যই পড়া উচিত বঙ্গবন্ধুর ‘ আমার দেখা নয়াচীন ‘
বইটির মূল্য -৪০০ টাকা মাত্র। বই কেনার জন্য রকমারিতে খুজ নিতে পারেন।

পাঠক,লেখক,বিতার্কিক,মুক্তমনা জ্ঞানপিপাসু।